স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার প্রথিতযশা রাজনীতিক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা এবং চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদুল হক বিশ্বাস ও চুয়াডাঙ্গা জজ আদালতের সাবেক পিপি মো. বেলাল হোসেন। এ ছাড়া রাত ৮টার দিকে জেলা শহরের একাধিক ব্যক্তির ফেইসবুকে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে রাত ৯টার দিকে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগর তার ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে জোয়ার্দ্দার ছেলুনের মৃত্যুর খবর পোস্ট করেন। এ বিষয়ে তার পরিবার নিশ্চিত করেছে গণমাধ্যমকে। সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার সেলুন ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গত বছরের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছেলুন জোয়ার্দ্দার স্বপরিবারে আত্মগোপনে চলে যান। সেই সময় তার বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর থেকে তিনি কোথায় ছিলেন তা কেউ বলতে পারেনি। বেশ কয়েক বছর ধরে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন ৭৯ বছর বয়সি এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাধিকবার তিনি ভারতে ও ব্যাংককে চিকিৎসাও নিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী আক্তারি জোয়ার্দ্দার ও একমাত্র কন্যা তাবশিনা জান্নাত প্রথমাসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন’ যাকে সবাই মেজো ভাই হিসেবেই জানতেন। যিনি ছিলেন চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের একজন প্রবাক পুরুষ, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, ক্রীড়া সংগঠক এবং চুয়াডাঙ্গা আওয়ামী লীগের বটগাছসম। মরহুমের জানাজা আজ শনিবার বেলা ১১টায় ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। পরে চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন সংলগ্ন জান্নাতুল মাওলা জামে মসজিদ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। সবাইকে জানাজায় অংশগ্রহণ করে তার রুহের মাগফিরাত কামনায় শরিক হওয়ার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন ১৯৪৬ সালের ১৫ মার্চ চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আরামপাড়া এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সিরাজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী এবং মাতা আছিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। তিনি চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী, তবে ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। পরে যুবলীগ গঠনের পর তিনি চুয়াডাঙ্গা মহকুমা যুবলীগের সভাপতি, ১৯৭৩ সালে চুয়াডাঙ্গা যুবলীগের সভাপতি এবং ১৯৭৯ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৯৭১ সালে মুকুটবাহিনীর সদস্য হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এবং ক্রমে নিজেকে একজন জনপ্রিয় জননেতায় পরিণত করেন। রাজনীতির মাঠে তার অবস্থান ছিলো সুদৃঢ় ও নিবেদিত। তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি বিভিন্ন সংসদীয় কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেন এবং হুইপ হিসেবেও দায়িত্ব পান। শুধু রাজনীতি নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। ২০১২ সালে তিনি চুয়াডাঙ্গায় ‘ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা আজও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষ পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০২৪ সালের আগস্টে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। তার স্ত্রীসহ পরিবারের কয়েকজনের বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয় এবং ৩৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তার মৃত্যুতে চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সহকর্মী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণ তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন। সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন একজন সংগ্রামী নেতা ছিলেন, যিনি রাজনৈতিক মাঠ, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নিজের ছাপ রেখে গেছেন। তার কর্ম ও অবদান দীর্ঘদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ছেলুন জোয়ার্দ্দারের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের জন্ম ১৫ মার্চ ১৯৪৬ সালে। মরহুমের পৈতৃক নিবাস চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের আরামপাড়া এলাকায়। তার পিতার নাম মরহুম সিরাজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার এবং মাতা মরহুমা আছিয়া খাতুন। তিনি ছিলেন মরহুম সিরাজুল ইসলামের ৭ কন্যা ও ৫ ছেলের মধ্যে মেজো। তাইতো সকলে তাকে মেজো মিয়া বা মেজো ভাই বলেই ডাকতেন। পিতা পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ছেলুন জোয়ার্দ্দার চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিক পাস করে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে উচ্চতর শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন। পেশায় ব্যবসায়ী সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার (ছেলুন) রাজনীতির সঙ্গে ও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবন হতেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পর তিনি চুয়াডাঙ্গা মহকুমার সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৩ সালে চুয়াডাঙ্গা যুবলীগের সভাপতি, ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগের জেলা সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। দলের জন্য একনিষ্ঠ কর্দমক্ষতা ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় পরবর্তীতে তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর বারবার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি তাকে ঘিরে এই আবর্তিত হয়েছিলো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেই ছিলেন। একাত্তরের বীর সেনানি বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ছেলুন জোয়ার্দ্দার চুয়াডাঙ্গা রাইফেল ক্লাব, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার (দীর্ঘ ২ যুগের বেশি সময় ধরে) সেক্রেটারি দায়িত্ব পালন করেছেন। চুয়াডাঙ্গা ফুটবলের গৌরবময় সোনালী অতীত ছেলুন জোয়ার্দ্দারের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিলো। ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সপ্তম ও ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে থেকে অংশ নিয়ে পরাজিত হলেও প্রচ- ধৈর্য্যরে মুর্তমান প্রতীক হিসেবে তিনি রাজনীতি থেকে পিছপা হননি। তিনি ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে দশম, ২০১৮ সালে একাদশ ও ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে থেকে মনোনয়ন লাভ করেন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারত পাড়ি জমালে পরদিন ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিলে তিনি সংসদ সদস্য পদ হারান।
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য হিসাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও তিনি সামাজিক উন্নয়নে যে কাজগুলো করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের প্রথম বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব চুয়াডাঙ্গা প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সম্মুখ সমরে চুয়াডাঙ্গার যে ৮ অকৃতভয় মুক্তিযোদ্ধা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন সেই সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দামুড়হুদার নাটুদা আটকবর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ, চুয়াডাঙ্গার খেলাধুলার উন্নয়নে চুয়াডাঙ্গা জাফরপুর আধুনিক মানের একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ, যুব ভবন ও যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকাসহ চুয়াডাঙ্গার সামাজিক উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার প্রস্থানে চুয়াডাঙ্গার রাজনৈতিক অঙ্গণে আওয়ামী লীগের মধ্যে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। প্রবীণ এই নেতার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে জেলার মানুষ, রাজনৈতিক সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রাতেই ঢাকার গুলশানের আজাদ মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১২টার দিকে মরদেহ নিয়ে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা। আজ শনিবার বেলা ১১টায় চুয়াডাঙ্গা ফাস্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটিতে তার নামাজে জানাজা শেষে জান্নাতুল মাওলা কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।