স্টাফ রিপোর্টার: আট মাসের জার্নি। এখনো চলছে আলোচনা। সামনে আরও আলোচনা করার প্রত্যয়। অঙ্গীকার অনুযায়ী সময় রয়েছে আর মাত্র ৪১ দিন। এর মধ্যে কার্যদিবস রয়েছে আরও কম। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০ দিন। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি মতামতের ওপর তৈরি করতে চায় জাতীয় সনদ, যা ‘জুলাই সনদ’ হিসেবে এরই মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়গুলো থাকবে ওই সনদে। আর স্বাক্ষর নেয়া হবে সব রাজনৈতিক দলের। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য নিয়ে। এ সময়ের মধ্যে সব রাজনৈতিক দল মৌলিক সংস্কার ইস্যুগুলো নিয়ে একমত হতে পারবে কি না? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাই। তাদের বক্তব্য, একমতের মধ্যেও রয়েছে নানান ধরনের দ্বিমত। কোনো ইস্যুতে কয়েকটি রাজনৈতিক দল একমত হলেও কোনো কোনো দল আবার ভিন্নমত দেখাচ্ছে। আবার কেউ ওই মতের সঙ্গে বাড়তি প্রস্তাব যোগ করছে। তাই যেসব রাজনৈতিক দল কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে ভিন্নমত পোষণ করছে, তারা জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বা সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে জাতি। তবে এসব বিষয় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বা সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। তবে তারা মতের গতিবিধি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখে পরে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এখন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ চলছে। গত সপ্তাহে টানা তিন দিন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি বিষয়ে দলগুলো একমত হতে পেরেছে বলে জানিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে অর্থবিল ও আস্থা ভোট ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা, সরকরি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি, প্রিভিলেজ কমিটি, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে বিরোধী দলের সদস্যদের নির্বাচিত করা, সংরক্ষিত নারী আসন এক শতে উন্নীত করা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিদ্যমান পদ্ধতি পরিবর্তন ও তার ক্ষমতা বাড়ানো। বাকি বিষয়গুলোয় দলগুলো এখন পর্যন্ত একমত হতে পারেনি। তবে চলতি সপ্তাহে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে আরও বেশ কয়েকটি মৌলিক ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে কমিশন।
এরই মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ ঘটনাবহুল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সংলাপে প্রথম ধাক্কাটা আসে জামায়াতের ইসলামীর কাছ থেকে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতির প্রতিবাদে সংলাপ প্রতীকী বয়কট করে তারা। পরে প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাসের পর তারা সংলাপে যোগ দেয়। এরপর সংলাপে জামায়াতে ইসলামীকে বেশি সময় দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে সংলাপ থেকে কিছু সময়ের জন্য ওয়াকআউট করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও গণফোরামের প্রতিনিধিরা। এ ছাড়া জাতীয় ঐক্যমত কমিশনের সংলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় নাগরিক কমিটিও। আবার একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন না থাকার পরও সংলাপে ডাকা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। এ ছাড়া সংলাপের আসনবিন্যাসের প্রতিবাদ জানিয়ে সামনের সারি থেকে পেছনের সারিতে গিয়ে বসেন দুটি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসনবিন্যাস নিয়ে আমরাসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা অসন্তুষ্ট হয়ে নির্ধারিত আসনে না বসে পেছনের সারিতে বসেছি।’ অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ১৪-দলীয় মহাজোটের দুই শরিক দলকে আমন্ত্রণ জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও বাংলাদেশের লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইবেন বলে জানিয়েছেন নুর। আগামীতে এমনটি হলে ওয়াকআউট করার হুমকি দিয়েছেন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান। জানা যায়, প্রথম ধাপের আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো মোটা দাগে মাত্র ৪২টিতে একমত হয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০টি প্রস্তাবের মধ্যে মোটা দাগে একমত ৭টিতে, বিচার বিভাগের ২৩টির মধ্যে ৮টিতে, সংবিধান সংস্কারের ৭০টির মধ্যে ১০টিতে, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের ২৭টির মধ্যে ৮টিতে ও জনপ্রশাসন সংস্কারের ২৬টির মধ্যে ৯টিতে ঐকমত্য হয়েছে। অন্য ১২৪টি সংস্কার সুপারিশের সঙ্গে দলগুলো মোটা দাগেও একমত হতে পারেনি। প্রথম ধাপে দলগুলোর সঙ্গে মোট বৈঠক হয় ৪৫টি। ৩ জুন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু করেছে কমিশন।
রাজনৈতিক দলগুলো ও বিশ্লেষকরা জুলাই সনদ নিয়ে সন্দিহান হলেও জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরির কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘সব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত হবে না। আমরা কিছু জায়গায় একমত হব। বাকিটা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জনগণ কতটা গ্রহণ করবে সেটা তাদের বিষয়।’ জুলাই সনদ ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে-জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংস্কারের জন্য নির্বাচন যদি পিছিয়ে যায়, সংঘাত হয় তাহলে সেটা হবে দুঃখজনক। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনের দাবিতে অনেকটা অনড় অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে ইসলামি দলগুলো নির্বাচনের আগে সংস্কার নিয়ে কথা বলছে। এসব কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিভেদ দেখা দিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বিভেদ বা রাজনৈতিক সংঘাত এড়াতে ড. ইউনূস সরকারের উচিত এখন থেকে পদক্ষেপ নেওয়া। বিশেষ করে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসা।’