তিন আসমানি ধর্মের পবিত্র স্থান জেরুজালেমের ইতিহাস

জেরুজালেম—এক অনন্য নগরী, যার ইতিহাস পৃথিবীর অন্য যেকোনো শহরের ইতিহাসের চেয়ে আলাদা। এটি একই সঙ্গে তিনটি আসমানি ধর্মের পবিত্র কেন্দ্র এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সবচেয়ে জটিল ইস্যু।

মুসলমানদের জন্য এখানে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ, যা ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান। প্রথম যুগে এখানেই ছিল মুসলমানদের কিবলা, পরবর্তীতে কিবলা পরিবর্তিত হয়ে মক্কায় নির্ধারিত হয়।

এখানেই গম্বুজে-সাখরা, যেখান থেকে নবী করিম (সা.) মিরাজে গমন করেন। একই স্থানকে ইহুদি ও মুসলমান উভয়েই হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর কোরবানির প্রস্তাবের স্থান বলে মান্য করেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকেই জেরুজালেমে মানুষের বসতি ছিল। তখন এর নাম ছিল জেবুসাইট, একটি কানানীয় নগরী। কানানীয় ও ফিলিস্তিনিরাই আজকের ফিলিস্তিনিদের পূর্বপুরুষ। জাফা থেকে গাজা উপকূল পর্যন্ত তাদের বসতি গড়ে ওঠে। সেখান থেকেই “ফিলিস্তিয়া” বা “প্যালেস্টাইন” নামটির উৎপত্তি।

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে ইসরাইলি রাজা দাউদ জেরুজালেম দখল করে এটিকে সুরক্ষিত নগরীতে রূপ দেন। তার পুত্র সলোমন এখানে মন্দির নির্মাণ করলে জেরুজালেম ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান—সবার কাছে আধ্যাত্মিক রাজধানীতে পরিণত হয়।

কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যাবিলনীয়রা মন্দির ধ্বংস করে। পরবর্তীতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, পটলেমি, সেলিউকাস প্রমুখ একে দখল করে। প্রথম শতাব্দীতে এটি মাকাবীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় এবং পরে দীর্ঘ রোমান শাসনের অধীনে আসে।

রোমান আমলে বেথলেহেমে জন্ম নেন যিশু খ্রিস্ট—খ্রিস্টানদের মতে ঈশ্বরের পুত্র এবং মুসলমানদের মতে একজন মহৎ নবী। তার আহ্বান ছিল এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি। কিন্তু জেরুজালেমেই তাকে রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলট বিদ্রোহের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন।

খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, তাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় প্রতীক হয়ে ওঠে। এ সময়ই নির্মিত হয় খ্রিস্টানদের সর্বাধিক পবিত্র গির্জা চার্চ অব দ্য হোলি সেপালকার।

খ্রিস্টাব্দ ৭০ সালে রোমান সম্রাট টাইটাস ইহুদি বিদ্রোহ দমন করে মন্দির ধ্বংস করেন। ১৩৫ সালে সম্রাট হ্যাড্রিয়ান শহরের নামকরণ করেন এলিয়া ক্যাপিটোলিনা, আর ভূমির নাম হয় প্যালেস্টাইন। খ্রিস্টাব্দ ৩১৩ সালে খ্রিস্টধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ার পর সম্রাজ্ঞী হেলেনা জেরুজালেমকে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রার কেন্দ্রে পরিণত করেন।

ইসলামের আবির্ভাবের পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা উমর (রা.)-এর সময় সেনাপতি আবু উবাইদাহ শহরটি দখল করেন। পরে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের আমলে নির্মিত হয় গম্বুজে-সাখরা এবং কিছুদিন পর আল-আকসা মসজিদ। এই পবিত্র স্থানটি মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে চিরকালীন মর্যাদা লাভ করে।

একাদশ শতকে ক্রুসেডাররা ১০৯৯ সালে শহর দখল করে নির্বিচারে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের হত্যা করে। কিন্তু ১১৮৭ সালে সালাহউদ্দীন আইউবি শহর পুনর্দখল করে ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি প্রতিশোধ না নিয়ে নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলেন।

পরবর্তীতে মামলুক ও উসমানীয় আমলে শহর পুনর্গঠিত হয়। উসমানীয় সুলতান সুলায়মান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট শহরের প্রাচীর ও গম্বুজে-সাখরার বহির্ভাগে অনবদ্য টাইলস নির্মাণ করান, যা আজও জেরুজালেমের শোভা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ বাহিনী জেরুজালেম দখল করে। একই বছর বেলফোর ঘোষণা ইহুদিদের জন্য একটি “জাতীয় স্বদেশভূমি”র সমর্থন জানায়। এর পর থেকেই জেরুজালেমের ভাগ্যে শুরু হয় এক নতুন দ্বন্দ্বময় অধ্যায়।

১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক প্রশাসনের অধীনে রাখার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পশ্চিম জেরুজালেম ইসরাইলের দখলে যায়, পূর্ব অংশ জর্দানের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে এটিকে তাদের “অখণ্ড রাজধানী” ঘোষণা করে, যদিও আন্তর্জাতিক মহল এটিকে অবৈধ দখল হিসেবেই দেখেছে।

জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাব (২২৫৩, ২২৫৪, ২৫২, ২৬৭, ৪৭৮ ইত্যাদি) ইসরাইলি কর্মকাণ্ডকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। কিন্তু আজও দখলদারিত্ব ও বসতি স্থাপন অব্যাহত আছে।

ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী দাবি করে, অপরদিকে ইসরাইল সমগ্র জেরুজালেমকে চিরস্থায়ী রাজধানী বলে ঘোষণা করে।

আজকের দিনে জেরুজালেম শুধু ইতিহাস নয়, বিশ্ব-রাজনীতির জটিল সমীকরণ। মসজিদে-আকসার পবিত্র প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে শহরের প্রতিটি পাথরে বহমান রয়েছে ধর্মীয় আবেগ, রক্ত, অশ্রু ও আত্মত্যাগের এক দীর্ঘ কাহিনি। এ শহর তাই কেবল ভৌগোলিক সত্তা নয়—বরং বিশ্বাস, ইতিহাস ও সংগ্রামের চিরন্তন প্রতীক।