স্টাফ রিপোর্টার: জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে বিএনপির মামলা দায়েরের ছয় ঘণ্টার মধ্যেই ‘জনতা’ উত্তরার বাসা থেকে আটক করেছে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার একেএম নুরুল হুদাকে। আটকের পর তাকে লাঞ্ছিত করার একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের উপস্থিতিতেই দুটি জুতা রশি দিয়ে বেঁধে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। একপর্যায়ে একজন তার মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করছেন। তার শরীরের ডিম ছোড়া হয়। এরপরই পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানার ৫ নম্বর সেক্টরে তার বাসার সামনে এই ঘটনা ঘটেছে। উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, ‘জনতা’ তাকে ঘেরাও করে পুলিশে খবর দিলে পুলিশ গিয়ে নিয়ে এসেছে। পুলিশের ভাষ্য, তাকে কিছু ‘জনতা’ মব সৃষ্টি করে বাসা থেকে নিচে নিয়ে আসে। পুলিশকে খবর দেয়া হলে পুলিশ গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। বাসার নিচে কী ঘটেছে সেটা পুলিশ জানে না। ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার মহিদুল ইসলাম বলেন, শেরে বাংলা নগর থানার মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই পরে তাকে আদালতে পাঠানো হবে। এর আগে দুপুরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় সাবেক সিইসি নুরুল হুদাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএনপি। এ মামলার আসামির তালিকায় দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করা তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ২৪ জনের নাম রয়েছে। সাবেক সচিব নুরুল হুদা ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সব ভোট হয়। ২৪ জনের বিরুদ্ধে বিএনপির মামলা :প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। সাবেক এই তিন সিইসি হলেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি এ কে এম নুরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলার আবেদন জমা দেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল। যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করা হয়, তাদের মধ্যে আছেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের তৎকালীন সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ, নির্বাচন কমিশনার মো. আবদুল মোবারক, আবু হানিফ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী, শাহ নেওয়াজ ও তৎকালীন নির্বাচন সচিবসহ প্রধান নির্বাচন কমিশন অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তা। এই তালিকায় আরো আছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা। অভিযোগে আরো আসামি করা হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি একেএম নুরুল হুদা, নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে। অভিযোগে একই সময়ে দায়িত্ব পালন করা তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী, তৎকালীন ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ, সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক প্রধান (অজ্ঞাত), জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক প্রধান (অজ্ঞাত) এবং পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ নুরুল আলমের নাম উল্লেখ আছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব, আলমগীর হোসেন, আনিছুর রহমানসহ তৎকালীন নির্বাচন সচিবেরও নাম আছে ঐ আবেদনে। আবেদনে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, গুরুতর জখম ও হত্যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। পাশাপাশি তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর হওয়া হামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে নির্বাচন বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। নির্বাচন কমিশনে বিএনপির আবেদন : বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বর্তমান কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত একটি চিঠি এবং মামলার আবেদনের কপি প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসিরুদ্দিনের কাছে একটি চিঠি পৌঁছে দেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন খান। বিএনপির প্রতিনিধিদলে আরো ছিলেন মো. মিজানুর রহমান, মো. ইকবাল হোসেন, শরিফুল ইসলাম ও নাঈম হাসান। সালাহ উদ্দিন খান বলেন, বিতর্কিত এই তিন নির্বাচনকে ঘিরে বারবার অভিযোগ করার পরেও তৎকালীন সিইসি ও সংশ্লিষ্টরা কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা আশা করি, বর্তমান নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সিইসি, ইসি ও সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কমিটি গঠনের ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় বিএনপি এমন পদক্ষেপ নিল। সিইসির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে সালাহ উদ্দিন খান বলেন, এখানে সিইসি ও ইসি সচিব ছিলেন। আমরা তাদের কাছে অভিযোগ জমা দিলাম। আমরা জানি, বর্তমান কমিশন এ অভিযোগের বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। তারা (আগের কমিশন) যেহেতু সংবিধান লঙ্ঘন করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, এজন্য তাদের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা থানায় এজাহার করা হবে। তিনি জানান, তিন সিইসি, নির্বাচন কমিশনার, তৎকালীন ইসি সচিবের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও মামলায় আসামি করা হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী আশ্বাস দিয়েছেন জানতে চাইলে এ বিএনপি নেতা বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার আমাদের বলেছেন, এখন কপি রিসিভ করেছেন, যা পারেন আইনি ব্যবস্থা নেবেন। সিইসি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তারা নিরপেক্ষ। আমরা আপনাদেরও নয়, কারো পক্ষে নয়। আমরা নিরপেক্ষ, যে আইনি ব্যবস্থা সেটা আমরা করবো। প্রসঙ্গত, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া ‘বিতর্কিত’ তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৬ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা শেষে তিনি এ নির্দেশ দেন বলে সরকারপ্রধানের দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।