বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-জোটের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা সম্পন্ন তত্ত্বাবধায়ক ও দ্বিকক্ষের সংসদে একমত : গণভোট-পিআর পদ্ধতি আর প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদে বহুমত

স্টাফ রিপোর্টার: বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। আলোচনায় অংশ নেয়া রাজনৈতিক দল-জোটগুলো মোটা দাগে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, মৌলিক সংস্কার, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার বিষয়ে প্রায় একমত হয়েছে। তবে গণভোট, সংসদের আগে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন, সংখ্যানুুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন প্রক্রিয়া, সংসদের মেয়াদ, সংসদ সদস্য পদে প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই সংবিধান সংস্কার এবং প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান পদে একই ব্যক্তির থাকা না থাকার মতো আটটি বড় ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যাত্রা শুরু করে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। আর গত ২০ মার্চ ড. কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দল-জোটগুলোর সঙ্গে কমিশনের আলোচনা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে গতকাল সোমবার বর্ধিত আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয় কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনা। উল্লেখ্য, পাঁচটি সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে মোট ৩৯টি রাজনৈতিক দল-জোটের কাছে স্প্রেডশিট (ছক আকারে) পাঠিয়ে মতামত জানতে চেয়েছিল ঐকমত্য কমিশন। সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবর ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। গতকাল সিপিবির সঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘দুই মাস আগে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনার সমাপ্তি ঘটেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অব্যাহত এই আলোচনায় অনেকগুলো বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি এবং বেশকিছু বিষয়ে আমাদের ভিন্নমতও রয়েছে। খুব শিগিগরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে, তা বিষয়ভিত্তিকভাবে আলোচনা করে দ্রুত জাতীয় সনদ তৈরিতে অগ্রসর হতে পারব।’ তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক আলোচনার বাইরে অনেক রাজনৈতিক দল অনানুষ্ঠানিক মতামতও দিয়েছে। সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় সনদ তৈরির দিকে এগিয়ে যাবে কমিশন।
সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ ঘোষণা ও সংস্কারের পরিধি নিয়ে চলমান বিতর্কের পাশাপাশি দ্বিমত দেখা দিয়েছে সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন করা না করা নিয়েও। শুরু থেকেই বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। আর ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় জামায়াত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে। গত পরশু রোববার কমিশনের সঙ্গে বর্ধিত আলোচনায় ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত করতে এবং এটিকে আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবও দিয়েছে জামায়াত। সংবিধান সংস্কার কমিশন ৩০০ আসনবিশিষ্ট নিম্নকক্ষ (আইনসভা) ও সেখানে আরও ১০০টি সংরক্ষিত আসন (নারীদের জন্য) এবং ১০০ আসনবিশিষ্ট উচ্চকক্ষ সংসদের সুপারিশ করেছে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই একমত। তবে, নিম্নকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে বিএনপি। অন্যদিকে, সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচনই পিআর পদ্ধতিতে চায় জামায়াত। এমনকি, সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রস্তাব দিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে-এজন্য প্রয়োজনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তিন দফায় আলোচনায় আগে সংসদ নির্বাচনের পক্ষে দলীয় অবস্থানের কথা জানিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে নিম্ন কক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেছে দলটি।
সংবিধান সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ করলেও নিম্নকক্ষের নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই করার পক্ষে মত দিয়েছে, আর উচ্চকক্ষের নির্বাচন আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার সুপারিশ করেছে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপি এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। তবে, জামায়াত সংসদের উভয় কক্ষের নির্বাচনই আনুপাতিক পদ্ধতিতে করার প্রস্তাব দিয়েছে।
উল্লেখ্য, সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবে না। ভোটাররা দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদের (নিম্নকক্ষ) আসন বণ্টন হবে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দল-জোটগুলোও। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এলডিপিসহ মিত্র দল-জোটগুলো বিএনপির অবস্থান বা প্রস্তাবের সঙ্গেই সহমত পোষণ করেছে। অন্যদিকে, এই দুটি ইস্যুতে চরমোনাই পিরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অবস্থানের মিল রয়েছে জামায়াতের সঙ্গে। এই দলগুলোও আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং সংসদের আগে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন দাবি করছে। চরমোনাই পিরের ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চেয়েছে গণঅধিকার পরিষদও। বৈঠক শেষে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে। আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের বিষয়েও আমরা একমত হয়েছি।
সংস্কার কমিশনের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বহুত্ববাদ’ এবং প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা—এই দুটি পদে আলাদা দায়িত্ব রাখা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। বিএনপি প্রস্তাবনায় ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এর বদলে তারা ২০১১ সালের আগে যেভাবে ছিল, সেই অনুযায়ী ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস’ বাক্যটি ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াতও চায় যে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন’ কথাটি থাকুক। এছাড়াও, দলটি ‘বহুত্ববাদ’ সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত, কারণ তারা বাংলাদেশে ইসলামি মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক গতিশীলতাকে আরো ভালোভাবে প্রতিফলিত করার জন্য ‘বহুত্ববাদ’ এর পরিবর্তে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ অন্তর্ভুক্ত করা পছন্দ করে।
জামায়াত ও এনসিপি প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের সীমা নির্ধারণের প্রস্তাবে একমত হয়েছে। রবিবার কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় জামায়াত প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, একজন ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না এবং একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। তবে, বিএনপি বলেছে, টানা দুটি মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকা যেতে পারে, তবে তৃতীয় মেয়াদের জন্য অন্তত একটি মেয়াদ বিরতি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ও সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর রাখার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াত। অন্যদিকে, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে।
আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা যেন একই ব্যক্তি না হন। বিএনপি এই প্রস্তাবে ভিন্নমত জানিয়েছে। এনসিপি এই দুটি পদ আলাদা করার পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের অবস্থান এখনো চূড়ান্ত হয়নি এবং তারা কমিশনের সঙ্গে আরো আলোচনা করবে। নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ তদারক করার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত দেখা গেছে। বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে, জামায়াত এই কাউন্সিল গঠনকে সমর্থন জানিয়েছে। এনসিপিও এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।
বিচার বিভাগে সংস্কার বিষয়ে বিএনপি কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছে। কমিশন প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে বেছে নেয়ার প্রস্তাব দিলেও, বিএনপি বলেছে-এই পদে তিন জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দেয়া উচিত। এছাড়া বিএনপি বিচারপতি নিয়োগে একটি ‘জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন’ গঠনের পক্ষে মত দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপিসহ দলটির মিত্র দল-জোটগুলো নির্বাচিত সংসদেই সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে, জামায়াতসহ কোনো কোনো দল অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই সংবিধান সংস্কারের পক্ষে।
গতকাল ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রথম পর্যায়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে কমিশন।