কষ্ট-সংগ্রাম পেরিয়ে সফলতার শিখরে ডিঙ্গেদাহের মো. হাসিবুল ইসলাম: কুঁড়েঘর থেকে আধুনিক স্টুডিওর স্বপ্নযাত্রা

শেখ রাকিব:স্বপ্ন দেখতে ভয় পাননি মো. হাসিবুল ইসলাম। অভাবের সংসারে যখন বাবা-মা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় ছেলেকে গান শেখাতে নারাজ, তখন তিনি নিজের ভেতরের সুরকে বাঁচিয়ে রাখতে বেছে নেন এক কঠিন সংগ্রামের পথ। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ডিঙ্গেদাহ ইউনিয়নের কুশোডাঙ্গা গ্রামের সেই স্বপ্নবাজ কিশোর আজ সংগীত জগতে এক পরিচিত নাম, সফল আধুনিক স্টুডিওর গর্বিত মালিক এবং বহু নবীন-প্রবীণ শিল্পীর আস্থার ঠিকানা। তার এই অর্জনের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ দিনের ত্যাগ, অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বপ্নের প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
মৃত আবুল হোসেন ও মাজেদা খাতুনের একমাত্র সন্তান মো. হাসিবুল ইসলামের সংগীতপ্রেম ছিল ছোটবেলা থেকেই প্রবল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে রেডিওর গান শুনে ঠোঁট মেলাতেন। গান শেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেও সাড়া মেলেনি বাবা-মায়ের। কারণ একটাই—সংসারে অভাব।
কিন্তু স্বপ্ন তার হৃদয়ে বাসা বেঁধেছিল। পরিবারের অজান্তে ভর্তি হন চুয়াডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমিতে। বিষয়টি জানাজানি হলে বকাঝকা শুরু হয়। সেদিনের সেই দৃঢ় কণ্ঠের উক্তিটি আজও মনে রেখেছেন সবাই—“গান ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।”
ছেলের এই জেদের কাছে অবশেষে হার মানেন বাবা-মা। এরপরই আসে জীবনের অন্যতম এক আত্মত্যাগের গল্প। গানের যন্ত্রের (হারমোনিয়াম) প্রয়োজন হলে ওস্তাদ আশরাফ উদ্দিন বাড়িতে এসে হাসিবুলের বাবার কাছে তার মেধা তুলে ধরে বলেন, “হাসিবুল খুবই মেধাবী। ওর গলায় আল্লাহর দেওয়া সুর আছে। একটা হারমোনিয়াম পেলে ছেলেটা অনেক দূর যাবে।”
ওস্তাদের কথা শুনে আবেগে গলে যান বাবা আবুল হোসেন। অভাবের সংসারে ছেলের স্বপ্ন যাতে না থামে, তাই তাদের একমাত্র পোষা গরুটি বিক্রি করে কেনা হয় একটি হারমোনিয়াম। তিন বছর শিল্পকলা একাডেমিতে দক্ষতা অর্জনের পর হাসিবুল পাড়ি জমান ঢাকায়।
স্বপ্নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি পরিবারকে না জানিয়ে নিজের ১০ কাটার জমি বিক্রি করে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে ১৫ থেকে ২০টি গানও রেকর্ড করেন, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। হতাশা নিয়েই দেশে ফিরে আসেন নতুন প্রত্যয়ে।
ঢাকায় তার পরিচয় হয় দুজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে, যারা শুরু থেকে তাকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন। তাদের সহযোগিতায় হাসিবুল কুশডাঙ্গার বাড়িতেই তৈরি করেন একটি আধুনিক মানের স্টুডিও। এটিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
স্টুডিও স্থাপনের পর গ্রামের ছেলে রাজু আহমেদের সঙ্গে মিলে নিয়মিত মিউজিক বানাতে শুরু করেন হাসিবুল। নিজের লেখা ও সুর করা গান ইউটিউবে প্রকাশ করেন। ধীরে ধীরে স্থানীয় শিল্পীদের গান রেকর্ড করার মাধ্যমে তার কাজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে।
একসময় কৌতুক অভিনেতা মুজিবর রহমান, এসকে লিটনসহ দেশের বিভিন্ন পরিচিত শিল্পী তার স্টুডিওতে গান রেকর্ড করতে আসেন। এতে পুরো এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শিল্পীদের এক ঝলক দেখার জন্য গ্রামের মানুষ হাসিবুলের বাড়ির সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন।
তাঁর জীবনের বড় অর্জন হিসেবে, চুয়াডাঙ্গার পরিচিত লেখক অ্যাডভোকেট মানি খন্দকার–এর লেখা তিনটি গান দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মনির খান হাসিবুলের স্টুডিওতেই রেকর্ড করেন পুত্রের সাফল্যে মায়ের চোখে জল মাজেদা খাতুন, হাসিবুলের মা, অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, “আমরা প্রথমে ওকে গান শেখাতে চাইনি। ভয় ছিল—পথ হারিয়ে যাবে। কিন্তু আজ দেখি—আমার ছেলেটা আল্লাহর রহমতে সফল হয়েছে। যখন দেখি বড় শিল্পীরা আমাদের ঘরে আসেন, তখন বুকটা আনন্দে ভরে যায়। আল্লাহ ওকে আরও বরকত দিন।”
দীর্ঘ সংগ্রামের পর আজ মো. হাসিবুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত একজন মিউজিক অ্যারেঞ্জার ও স্টুডিও শিল্পী। বর্তমানে তার মাসিক আয় প্রায় এক লক্ষ টাকা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেনমো. হাসিবুল ইসলামের অনুভূতি “অনেক কষ্ট করেছি। কখনো ভেঙে পড়েছি, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি। আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছি—স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। আজ আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। সবার দোয়া থাকলে আরও বড় কাজ করতে চাই।”
 এলাকার গর্ব, যুবকদের অনুপ্রেরণা
দীর্ঘ সংগ্রাম ও পরিশ্রমের পর হাসিবুল ইসলামের এই ঈর্ষণীয় সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তার জন্মভূমি কুশোডাঙ্গা গ্রামবাসী। তারা মনে করেন, হাসিবুল শুধুমাত্র একজন সফল শিল্পী নন, তিনি গ্রামের যুব সমাজের কাছে এক জলজ্যান্ত অনুপ্রেরণা।
স্থানীয় বাসিন্দা রিকন মোল্লা  বলেন “হাসিবুলকে আমরা ছোটবেলা থেকে চিনি। ওর গান শেখার শুরুর দিনগুলো খুব কষ্টের ছিল। বাবা-মায়ের অসম্মতি, তারপর অভাবের সঙ্গে লড়াই—সবই দেখেছি। আজ যখন দেশের বড় বড় শিল্পী ওর বাড়িতে এসে গান রেকর্ড করেন, তখন বুকটা ভরে যায়। ও প্রমাণ করেছে, ইচ্ছে আর পরিশ্রম থাকলে গ্রামের একজন ছেলেও কত বড় হতে পারে।”
সারজেত আলি নামে একজন জানান”আমি তার বাবার গরুটি বিক্রির ঘটনাও জানি। সেদিনের সেই ত্যাগ আজ সার্থক হয়েছে। হাসিবুল আমাদের কুশডাঙ্গা গ্রামের নাম উজ্জ্বল করেছে। ও শুধু নিজের ভাগ্য ফেরায়নি, এলাকার আরও কয়েকজন যুবকের কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। ও সত্যিই আমাদের গর্ব।”
 ইউপি সদস্য জামাল  “হাসিবুলের স্টুডিও হওয়ার পর থেকে আমাদের এলাকাটির পরিচিতি বেড়েছে। শিল্পীরা আসছেন, গ্রামে একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তার এই উত্থান এলাকার অন্য তরুণদের জন্য একটা বড় বার্তা—সঠিক পথে চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই।”
 প্রতিবেশী সুলতান বলেন “ওর সততা আর নম্রতা আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। এত সফলতা পাওয়ার পরও ও আগের মতোই আছে। যখন শুনি ওর মাসিক আয় লক্ষ টাকার কাছাকাছি, তখন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এই ছেলেটা একদিন অভাবে ছিল। ও আমাদের এলাকার মুখ।”
 সহকর্মী রাজু আহমেদ বলেন “আমি হাসিবুল ভাইয়ের পাশে থেকে তার সংগ্রাম দেখেছি। ঢাকায় ফিরে আসার পর যখন হতাশ ছিল, তখন আমরা দু’জন মিলে স্থির করি—গ্রামেই কিছু একটা করব। তার দূরদর্শিতা আর মিউজিকের প্রতি প্যাশনের ফলেই আজ এই স্টুডিওটি এত সফল। সে শুধু অ্যারেঞ্জার নয়, সে একজন প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা।”
 স্থানীয় রাকিব বলেন  “আমরা যারা গান বা মিউজিক নিয়ে কাজ করতে চাই, হাসিবুল ভাই আমাদের কাছে আদর্শ। তিনি দেখিয়ে , সঠিক প্ল্যাটফর্ম পেতে হলে শহর নয়, নিজের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। তার কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখছি।