গরু-ছাগলের নায্যমূল্য না পাওয়ায় নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা

 

রহমান মুকুল: আলমডাঙ্গা উপজেলায় গরু মোটাতাজাকরণ খামার আছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার, গাভীর খামার রয়েছে ৭ হাজারের অধিক। এছাড়া ছাগলের খামার রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। মোট গরুর সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। তাছাড়া উপজেলার অধিকাংশ কৃষকের বাড়িই একেকটি মিনি খামার। এ সব খামারের উদ্যোক্তা ও তত্বাবধায়ক পরিবারের গৃহবধূরা। উপজেলার প্রায় সকল পরিবারের গৃহিনী এভাবে ঘর-গৃহস্থালির পাশাপাশি গরু পালন করছেন। কোরবানি ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকী। ইতোমধ্যে কেউ কেউ লোকসানে গরু বিক্রি করলেও উপজেলার বেশিরভাগ গরু-ছাগল অবিক্রিত রয়ে গেছে। ধারদেনা ও ঋণ নিয়ে গরু মোটাতাজা করে খামারিরা এখন বিপদে। খামারিদের সাথে সাথে বিপদে পড়েছেন প্রায় প্রতিটি পরিবারের নারী খামারি বা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তারা। ফলে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকট হয়েছে। সাথে সাথে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সরকারের এসডিজি অর্জনে।

জানা যায়, দেশে প্রতিদিন বাড়ছে করোনাভাইরাসের প্রকোপ। সে কারণে গরু-ছাগল কেনাবেঁচায় চলছে চরম মন্দা। আর মাত্র কোরবানির কয়েক দিন বাকী। খামারিরা গরুর নায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত তো হচ্ছেনই, উপরোন্ত আদৌ বিক্রি করতে পারবেন কি-না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে আতঙ্কের ভেতর রয়েছেন খামারি ও গরু পালনকারীরা। এ অঞ্চলের গরু স্থানীয় হাট ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন পশুর হাটে বিক্রি করা হয়। প্রতিবছর পশু পালন করে লাভবান হয়ে আসছেন খামারিরা। অন্যান্য বছরগুলোতে কোরবানির মাস খানেক আগে থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যাপারীরা গরু-ছাগল কেনার জন্য চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গার বিভিন্ন হাট ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। কিন্তু এ বছর সেইসব ব্যাপারীদের তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া বড় বড় শহরে পশুর হাট বসা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। ইতোমধ্যে যারা বিক্রি করেছেন তাদের সকলেই লোকসান গুনে বিক্রি করেছেন। এখন আসল দাম ফিরে পাওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু মোটাতাজা করে বিপাকে পড়েছেন তারা। গরু-ছাগল বিক্রি করে খরচের টাকাও তুলতে পারছেন না খামারীরা। অনেক খামারীর অভিযোগ তাদের গরুর দামও জিজ্ঞেস করেননি কোনো ক্রেতা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু মোটা তাজা করে সঠিক দাম না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সকলে।

উপজেলার চরপাড়া গ্রামের ডাবলু জানান, স্বামী-স্ত্রী মিলেই বাড়িতে ৩টি গরু মোটাতাজা করেছেন। ২টি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গরু ৩টি কিনেছিলেন। গরুর খাবার বাকীতে আলমডাঙ্গা শহরের এক আড়ত থেকে কেনেন। এখন গরু বিক্রি করতে না পারায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। কীভাবে এনজিওর ঋণ ও খাবারের টাকা পরিশোধ করবেন?

কালিদাসপুরের আনোয়ার ও সাহেরা বানু দম্পতির ৩ সন্তান। আনোয়ার শহরে ছোটখাট ব্যবসা করেন। বাড়িতে স্রী সাহেরা বানু গরু ও মুরগি পালন করে পরিবারে সচ্ছ্লতা ফেরাতে চেষ্টা করেন।

সাহেরা বানু গরু নিয়ে ব্যস্ততার মাঝেও কথা বলেন, জানান, স্বামী সারাদিন ব্যবসার দৌঁড়াদৌঁড়িতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। তাই ঘরের কাজের পাশাপাশি তিনি নিজেই গরু ও মুরগির যতœআত্তি করেন। তিনি জানান, গত ৪ বছর ধরে গরু পালছেন। খরচ বাদে ভালই লাভ থাকে। কিন্তু এ বছর রোজার ঈদে লকডাউন থাকায় গরু বিক্রি করতে পারেন নি। এই ঈদেও পারছেন না। আরেক বছর পালন করতে হলে ৪ বছরে যে লাভ হয়েছে তা সবই চলে যাবে। ব্যবসা ছেড়ে সন্তানাদি নিয়ে পথে বসতে হবে।

পাঁচলিয়া গ্রামের ইজাল উদ্দীন দিনমজুরের স্ত্রী আনোয়ারা খাতুন বাড়িতেই থাকেন। গত ৫-৬ বছর ধরে তিনি গরু ও ছাগল পালন করেন। গরু ও ছাগল পালন করেই নিজে গত ৩ বছরে ২ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। গত বছর এক খন্ড জমি কিনেছেন বাড়ি নির্মাণের জন্য। গরু দুটি ১ বছর ধরে গরু মোটা তাজা করে সম্প্রতি হাটে নিয়ে হতাশ হয়েছেন স্বামী ইজাল উদ্দীন। যে গরুর দাম ২ লাখ টাকা সেই গরুর দাম ১ লাখ টাকা বলেছেন ব্যাপারিরা। তাই গরু বিক্রি না করে আবার খামারে ফিরিতে আনতে হয়েছে। এখন কীভাবে গরুর খাবারের দোকানের দেনা মেটাবেন তাই ভেবে উদ্বিগ্ন।

আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল কাফি জানান, বলা চলে আলমডাঙ্গা উপজেলার ২১১টি গ্রামে গ্রামে এক হাজার নারীকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যবসার নানা প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশ  নিজ পরিবারের কাজের পাশাপাশি গরু, ছাগল ও হাঁসমুরগি পালন করছেন। অর্থ উপার্জন করছেন। নারীদের এই অবদান পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণের ফলে দেশের উন্নয়নচিত্র দ্রুত পালটে যাচ্ছে। পরিবারে নারীদের কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে। নারীদের এই অবদানের জন্য গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু এ বছর গরু-ছাগলের প্রকৃত মূল্য না পেলে তারা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ তারা সকলেই উঠতি ব্যবসায়ী। অনেকের ব্যবসা আরম্ভের বয়স এক বছরও হয়নি। এমতাবস্থায় তারা লোকসানের মুখোমুখি হলে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হোঁচট খাবে।

আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন আলী বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা ও সামাজিক পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল। সেকারণে অর্থনৈতিক ভেঙ্গে পড়লে নারীর ক্ষমতায়ন অধরা থেকে যাবে।

ছবি: ছাগল চাষী।

Comments (0)
Add Comment