শেখ রাকিব: দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা চুয়াডাঙ্গা। শহরজুড়ে লক্ষ লক্ষ বহুতল ভবন আর হাজার হাজার বাড়ি, ব্যস্ত রাজপথ এই শহরকে আধুনিকতার প্রতীক করে তুলেছে। কিন্তু এই ঝকঝকে শহরের কোণেই আলোর বিপরীতে এক অন্য জীবন রয়ে গিয়েছে। যেখানে খোলা আকাশের নিচে দিনশেষে আশ্রয়ের খোঁজে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, রাস্তার পাশের বেঞ্চে, কিংবা আবর্জনার পাশে কিছু মানুষ জীর্ণবসন জীবন যাপন করে। তারা আমাদের শহরের বা অন্য এলাকার মানুষ, যাদের নেই কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা। নেই নিজের বলতে কিছুই। রোদ, বৃষ্টি আর ঝড়ের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকাটাই যেখানে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ তাদের, যেখানে একটি নিরাপদ ঘরের স্বপ্ন তাদের কাছে রূপকথার মতো। শহরের লোকজন যখন বড় বড় বিল্ডিংয়ে আরামদায়ক বিছানায় ঘুমায়, তখন তারা আশ্রয় খোঁজে খবরের কাগজে বা পুরনো কাপড় পরে কিংবা মাটিতে শুয়ে রাত যাপন করে। তারা বোঝেনা আরাম কাকে বলে; শুধু বোঝে ক্ষুধা, অনিরাপত্তা, আর রাত কাটানোর যন্ত্রণা। চুয়াডাঙ্গা জেলার রেলস্টেশন শুধু ব্যস্ত পদচারণার জায়গা নয়, এটি শত শত অসহায় মানুষের এক অবলম্বন। দিনের আলো ফুরিয়ে গেলে, শহরের কলরব থেমে গেলে এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম’র মেঝেই হয়ে ওঠে তাদের বিছানা আর পাথরের বেঞ্চগুলো দেয়াল। এই মানুষগুলো দয়া বা করুণা চায় না, সাপ বিচ্ছু বা মশা মাছির ভয় তাদের ভিতর নাই। তারা চায় একটু ভালোবাসা, একটু সম্মান আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। চায় এমন একটি নিরাপদ জায়গা, যেখানে তারা মানুষ হিসেবে বাঁচতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সমাজ তাদের প্রাসঙ্গিকতা ভুলে গেছে। সরকার, প্রশাসন, এমনকি রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ও সাধারণ মানুষের চোখেও তারা যেন এক ‘অদৃশ্য’ শ্রেণি। অথচ শহরটিকে গড়ে তোলার পেছনে এই প্রান্তিক মানুষেরাও কম কষ্ট করেনি। এই বাস্তবতা শুধু চুয়াডাঙ্গার নয়, এটি পুরো দেশের জন্য এক বড় প্রশ্ন: আমরা কী ধরনের সমাজ গড়ছি, যেখানে একটি ঘর পাওয়া এখনো অনেকের জন্য স্বপ্নের মতো? দৈনন্দিন শহর বড় হচ্ছে আকাশছোঁয়া দালান বাড়ছে। কিন্তু যদি শত শত মানুষ রাত কাটায় ফুটপাত বা রেলস্টেশনের মেঝেতে, তাহলে আমাদের উন্নয়ন কি সত্যিই পূর্ণতা পাচ্ছে? চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে উন্নয়নের আলোর পাশে, এখনো রয়ে গেছে এক গভীর ছায়া। সেই ছায়ায় আছে মানুষ, আছে গল্প, আছে কান্না, আর আছে বেঁচে থাকার এক অব্যক্ত সংগ্রাম। ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ড গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল হক বলেন, তিন বছর যাবত আজ আমি বাড়ি ছাড়া, তিন বছর আগে যখন আমার প্যারালাইসেন্স হয়ে এক সাইড পড়ে যায়, তখন আমার স্ত্রীসহ সন্তানেরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, সেই থেকেই আমি পথে পথে, সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে টাকা ইনকাম করি সেটা দিয়েই কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে রাত কাটায়, রাত হলেই চুয়াডাঙ্গার এই রেল স্টেশনে রাত যাপন করি। এ সময় তিনি বলেন, ছেলে মেয়েকে কতো কষ্ট করে লালন পালন করে বড় করেছি, কখনো ভাবিনি তারা আমাকে বাড়ি থেকে এইভাবে বের করে দিবে। এ সময় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আরও বলেন, এখন জীবনের চাওয়া পাওয়া বলতে কিছুই নেই, আল্লাহ যদি মৃত্যুটা দিতো তাহলে মুক্তি পেতাম এই নরকীয়ও জীবন থেকে।
এ সময় হাবিব হোসেন বলেন, সমাজে অনেক বড় বড় ব্যক্তি আছে যাদের টাকা-পয়সা ধন দৌলত কোনো কিছুরই কমতি নাই, কিন্তু আমাদের মত অসহায় মানুষের তারা যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে আমরা সেটা দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে পারি। আসলে সমাজ আমাদেরকে কিছুই দেয় না, দেয় শুধু শিক্ষা, আল্লাহ যাকে দিয়েছে তাকে অনেক দিয়েছেন, আর যাকে দেইনি তাকে কিছুই দেইনি, তবুও কোনো দুঃখ নাই কারণ আমি মনে করি আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে, হয়তো আমাকে পরীক্ষা নিচ্ছে। এ সময় জীবননগর উপজেলার আনসারবাড়িয়া গ্রামের খুদাবক্স বলেন, ৩০ বছর যাবত আমি মাটির হাঁড়ি-গুড়ি বিক্রি করি, বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জে হাটে বাজারে, প্রত্যেকদিন যা বিক্রি করি তা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মত, এরমধ্যে অনেক সময় খেয়ে না খেয়ে থাকি যদি এই টাকার মধ্যে আমি কেনো হোটেলে থাকি তা হলে সারাদিন যা ইনকাম করেছি তা কিছুই থাকবে না, তাই মাঝে মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে রাত হলেই চুয়াডাঙ্গার এই রেল স্টেশনে এসে মেজেতে সুয়ে পড়ি আর এখানেই রাত কাটায় কেনো রকম, আবার ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে রিজিকের সন্ধানে আবারো বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে হাটে বাজারে চলে যাই। এমন অসহায় শত শত মানুষ এই স্টেশনে এসে রাত যাপন করে।