পশ্চিম তীরে ৩০ লাখ ফিলিস্তিনির জীবন: ক্রমবর্ধমান সংকট ও দখলদারিত্বের ছায়া

স্টাফ রিপোর্টার:২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজার প্রতি বিশ্বব্যাপী মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলেও, একই সময় পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জনগণের কষ্ট ও সংকট ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়েছে। গাজার হামলার পর ইসরাইলের প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু হলেও, পশ্চিম তীরে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ইসরাইলি দখল ও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

পশ্চিম তীরের ভৌগলিক ও জনসংখ্যাগত প্রেক্ষাপট

পশ্চিম তীর একটি ৫,৬৬৫ বর্গকিলোমিটার স্থলবেষ্টিত এলাকা, যা জর্ডান নদীর পশ্চিমে এবং ইসরাইলের পূর্ব পাশে অবস্থিত। এখানে প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করে, যাদের মধ্যে অনেকেই শরণার্থী। অন্যদিকে প্রায় ৭ লাখ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী অবৈধভাবে জমি দখল করে আছে। পশ্চিম তীরের তুলনায় গাজার আয়তন অনেক ছোট হলেও, এখানে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা ও সংকট অনেক গুণ বেশি গভীর।

ইতিহাস ও প্রশাসনিক বিভাজন

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইল পশ্চিম তীর দখল করে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম তীর তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়:

– **এরিয়া এ:** ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
– **এরিয়া বি:** আংশিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তার দায়িত্ব ইসরাইলের।
– **এরিয়া সি:** ইসরাইলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা।

যদিও আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে এ সব বিভাজন ছিল, বাস্তবে ইসরাইল পুরো অঞ্চলটিই নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে সেনারা প্রায় অবাধে অভিযান চালায়।

সাম্প্রতিক সহিংসতা ও মানবিক সংকট

গত দুই বছরে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের হামলা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে প্রায় ৭,৫০০ বার অভিযান চালানো হয়েছে, যার ফলে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ও মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯৯৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২১২ জন শিশু।

শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভিড় ও সংকট অতিরিক্ত। বিশেষ করে বালাতা শিবিরের মতো জায়গায় হাজার হাজার মানুষ অত্যন্ত ক্ষীণ জায়গায় বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। ত্রাণ সরবরাহ ও জমি ব্যবহারেও ইসরাইল কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যা মানবিক পরিস্থিতিকে আরও করুণ করে তুলেছে।

ইসরাইলি বসতি স্থাপন ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

২০২৫ সালের আগস্টে ইসরাইল ‘ই-১ সেটেলমেন্ট প্লান’ অনুমোদন করে, যা পূর্ব জেরুজালেমের সাথে নতুন বসতি স্থাপনকে সংযুক্ত করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই পরিকল্পনাকে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখছে। জাতিসংঘ, আরব লীগ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পদক্ষেপের কঠোর নিন্দা জানিয়েছে এবং এটিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে ঘোষণা করেছে।

পশ্চিম তীরের ভবিষ্যত: অনিশ্চয়তার মধ্যেই ক্রমবর্ধমান সংকট

ইসরাইলি সামরিক অভিযান ও বসতি স্থাপনের কারণে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জনগণের জীবন প্রতিদিন আরও অনিরাপদ ও অসহনীয় হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতায় ফিলিস্তিনিদের জন্য শান্তিপূর্ণ জীবন ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।

এই সংকটের গুরুত্ব ও প্রভাব শুধু প্রতিবেশী অঞ্চলে নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকারের প্রশ্নেও গভীর প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের আরও সক্রিয় ভূমিকা ও ন্যায়সঙ্গত সমাধানের প্রচেষ্টা অপরিহার্য।