অন্তর্বর্তী সরকারে সমন্বয়হীনতা

উপদেষ্টাদের কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতর সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। সরকারের ভেতরে-বাইরে প্রায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্যে এসব প্রকাশ পাচ্ছে। সম্প্রতি একটি ঘটনায় এক উপদেষ্টা এর নিন্দা জানিয়ে বিচার দাবি করেন। একজন বলেন, সরকারকে এর দায় নিতে হবে। সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। আরেকজন বলেন, আমরা এর বিচার দাবি করছি। এদিকে রাজনৈতিক দলের নেতারাও সরকারের সমালোচনায় সরব। এক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে জুলাই বিপ্লবের পর জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। উপদেষ্টাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী সম্পর্কেও আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় চীন থেকে ফিরে সোমবার রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের সাক্ষাতের ঘটনা নানা গুঞ্জনের জন্ম দেয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে গুজব। সব মিলিয়ে জনমনে অস্থিরতা-অস্বস্তি বিরাজ করছে। দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের প্রশ্ন-কী ঘটছে পর্দার অন্তরালে? অনেকেই জানতে চান শিগ্গিরই কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসছে। বর্তমান সরকার কি চলে যাচ্ছে, তাদের অধীনে নির্বাচন হবে কি না। এছাড়া অনেকের প্রশ্ন-ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি। এমন নানা প্রশ্ন বিভিন্ন মাধ্যমসহ জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন না প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে। এজন্য যে যার মতো করে কথা বলছেন, অবস্থার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। যার সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার বিস্তর ফারাক। এসব কারণে ডালপালা ছড়াচ্ছে গুজব। বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এতে জনমনে অস্থিরতা-অস্বস্তি ক্রমেই বাড়ছে। অধিকাংশের মনে প্রশ্ন-দেশে হচ্ছেটা কী।

অনেকে বলছেন, আমরা সরকারের কাছে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরের ওপর হামলার বিচার চাইব। সরকার বিচার করবে, এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করবে। কিন্তু সরকারের অংশ উপদেষ্টারা যদি বলেন এ ঘটনার নিন্দা জানাই, সরকারকে এর দায় নিতে হবে, তাহলে জনগণ কোথায় দাঁড়াবে। সরকার মানে শুধু প্রধান উপদেষ্টা নন, সব উপদেষ্টা মিলেই সরকার। যাদের বিচার করার কথা, সেই উপদেষ্টারাই যদি নিন্দা জানান, বিচার চান; তাহলে সরকারের মধ্যে যে সমন্বয়ের অভাব আছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেতে দেখছি। রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনাবলি ও নির্বাচনি প্রক্রিয়াগুলো আমরা দেখছি। সংস্কার কমিটির প্রস্তাব যেন মাঝপথ থেকে এগোতে পারছে না। এটা কি আকাঙ্ক্ষার অভাবের ফল না সক্ষমতার অভাব, নাকি বড় ধরনের স্বার্থের সংঘাত লুকিয়ে ছিল? অন্তর্বর্তী সরকার কি পথ হারিয়েছে-এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আমাদের মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। সোমবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে ‘বাংলাদেশ রিফর্ম ওয়াচ’ নামের সূচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর সবাই যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করে, তাহলে একটি অরাজনৈতিক সরকারের পক্ষে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা খুবই কঠিন। বর্তমান পরিস্থিতিতে নানাজন নানা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। নানাকেন্দ্রিক চাপ প্রয়োগ করে এজেন্ডাভিত্তিক দাবি আদায়ের চেষ্টাও হচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোও যে যার মতো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সরকারকে পরিপূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা করছে না। এর ফলই এখন সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, সংস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য-সব ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে দৃশ্যমান ফাটল ধরায় এ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।’

জানা যায়, শুক্রবার রাতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ন্যক্কারজনক হামলার পর পরিস্থিতি বেশি ঘোলাটে হয়েছে। হামলার পর সরকারের উপদেষ্টারা যে যার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। ওই রাতেই আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এক ফেসবুক পোস্টে নুরের ওপর বর্বরোচিত হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তার পোস্টে এক কমেন্টে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ। কমেন্টে তিনি লেখেন, ‘প্রতিবাদের কাজ আপনার? ভন্ডামি বাদ দেন স্যার। যেই জন্য বসানো হয়েছে, সেটা না করে কী কী করছেন। এসবের হিসাব দিতে হবে। কে কোথায় কীভাবে কোন কাজে বাধা দিয়েছে-এসব খবর আমাদের কাছে আছে। এসব প্রতিবাদের ভং না ধরে কাজটা করেন।’

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার দায়দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে। সরকারকে এটার সমাধান করতে হবে। এই হামলার বিচার করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা কেউ ঘটানোর সাহস না করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নুরকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। সরকারের উপদেষ্টা হয়ে তার এমন বক্তব্য হাস্যরসের জন্ম দেয়। এক প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, ‘কোনটা মব, আর কোনটা রাজনৈতিক কর্মসূচি, সেই পার্থক্য বুঝতে হবে। রাজনৈতিক দল কীভাবে মব করে? একটি নিবন্ধিত দলের কর্মসূচিকে কীভাবে মব বলবেন? এটাকে ‘মব’ বলে একটা পক্ষকে নিউট্রালাইজড করা এবং আরেকটা পক্ষকে ফ্যাসিলিটি দেওয়া ঠিক হবে না।’

বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নুরের ওপর হামলার পেছনে নির্বাচনকে পেছানো বা ব্যাহত করার একটি পরিকল্পিত উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বিএনপির নেতারা ইতোমধ্যে বলেছেন, পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে ব্যাহত করতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করার জন্য একটা মহল কাজ করছে।

নুরের ওপর হামলা এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে বলেছে গণঅধিকার পরিষদ। দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, নুরের ওপর হামলা করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এটি কোন ধরনের বর্বরতা!

অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাবাহিনী কাদের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনাকে ‘মব ভায়োলেন্স’ আখ্যা দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ ধরনের অবস্থান দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। সেনাবাহিনীর উচিত অবিলম্বে বিবৃতি প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়া। রোববার রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরকে দেখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, নুরের ওপর হামলার খবর আমরা চীন থেকে শুনে উদ্বিগ্ন হয়েছি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এমন ঘটনা আমরা কল্পনাও করিনি। এই হামলা শুধু দুঃখজনক নয়, এটা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সেনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ফ্যাসিবাদবিরোধী নেতার ওপর এমন হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

জানা যায়, সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে সেনাপ্রধান চলমান পরিস্থিতিতে তার বাহিনীর কাজ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়ার কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। সেনাপ্রধান অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করবেন বলে জানান।

সোমবার রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এ মুহূর্তে একটি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই ঝড়ের আঘাত আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামাজিক জীবনসহ সব ক্ষেত্রে অনুভূত হচ্ছে। ঝড় যখন আসে, তখন মানুষ তার সবচেয়ে বড় সম্পদ রক্ষা করার চেষ্টা করে। এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে যে বৈষম্যবিরোধী চেতনা পেয়েছি, সেটা রক্ষা করা। সেই বৈষম্যবিরোধী চেতনা বাস্তবায়নের জন্য মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা জেগেছে, সেটা ধরে রাখা একটা বড় কাজ হবে।