রহমান মুকুল: জীবন সংগ্রামে হার না মানা এক অদম্য নারী উদ্যোক্তা হিরা খাতুন। তিনি আজ এলাকায় একমাত্র সফল ও দৃষ্টান্তস্থাপনকারী মহিলা উদ্যোক্তা। যেমন বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর কেন্দ্র ও আবরণের মাঝে প্রচ- তাপ ও চাপের কারণে হিরা গঠিত হয়, তেমনই শত বাঁধার বিন্দ্যাচল ডিঙ্গিয়ে তিনি আজ সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন।
জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়েছে যে দুর্ঘটনা: ছোটবেলায় হিরার গায়ে আগুন লেগে তার পিঠ পুড়ে যায়। এরপর হিরা বড় হয়ে গেলেও তার পিঠে পোড়ার চিহ্নটা থেকে যায়। দেখতে রূপবতী হিরার এক সময় ধুমধাম করে বিয়েও হয়। কিন্ত সে বিয়ে টেকেনি। পিঠ পোড়ার চিহ্নের মতো হিরার জীবনে আরও একটি কালো অধ্যায় যোগ হয়। এ ঘটনার পর তিনি যারপরনাই অসহায় হয়ে পড়েন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এরপর তিনি ক্রমেই নিজের মনকে শক্ত করে তোলেন। মনস্থির করেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
প্রেরণা দিতেন প্রবাসী দুলাভাই: এ সময় নিজের ছোট বোনের মতো আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন প্রবাসী বড় দুলাভাই জমিরুল ইসলাম। তার পরামর্শে হিরা প্রথমে বাড়ির গোয়ালঘরে ছয়টি গরু তোলেন মোটাতাজা করার জন্য। গরু তাজামোটা ও বড় হতে থাকে। গরুগুলোর সাথে সাথে হিরা খাতুনের মনোবলও দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। শত বাঁধা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। গরুর ফার্ম করে আজ স্বাবলম্বী তিনি। তিনি সফল মহিলা উদ্যোক্তা হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এলাকায়। এবার কোরবানির ঈদে প্রায় কোটি টাকার গরু বিক্রি করবেন। আশা করছেন খরচ বাদে লাভ হবে ১৬-১৭ লাখ টাকা।
সফল নারী উদ্যোক্তা হিরা খাতুনের পরিচয়: চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের হিরা খাতুন ‘জান্নাত অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। তিন বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে হিরা খাতুন মেজ। ভাই প্রবাসী। ২০১৭ সালে তিনি মাত্র ৬টি গরু মোটাতাজা করার মধ্য দিয়ে শুরু করেন অভিষ্ঠ স্বপ্নযাত্রা। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে আজ তিনি এলাকায় নারী উদ্যোক্তাদের আইকনে পরিণত হয়েছেন। অনেকে আশ্চর্য হবেন জেনে যে – সফল নারী উদ্যোক্তা আইকনের বয়স এখন মাত্র ৩০ বছর। এ বছর তার ‘জান্নাত অ্যাগ্রো ফার্ম’এ ১০০টি গরু। দুজন কেয়ারটেকার সার্বক্ষণিক ফার্ম রক্ষনাবেক্ষণ করেন।
জান্নাত অ্যাগ্রো ফার্মের পরিচালক হিরা খাতুন জানান, ২য় শ্রেণিতে পড়ার সময় আগুনে শরীর পুড়ে যায়। সুস্থ হওয়ার পর আবার পড়াশোনা করি। অনার্স শেষ করার পর পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় আলমডাঙ্গায়। আগুনে পোড়ার কারণে স্বামী ডির্ভোস দেন। দুলাভাই আমাকে সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে কয়েকটি গরু কিনে দেন। গরু পালন করে আজ আমি স্বাবলম্বী। গরুর খামার দেখাশুনার পাশাপাশি কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যায়ন করছি। প্রথমে ৬টি গরু বিক্রি করে লাভ ভালো হওয়ায় পরের বছর ১৫টি গরু পালন করি। ২০২০ সালে বড় পরিসরে গরুর খামার করেছি। দুটি খামারে ১০০টি বড়-ছোট গরু পালন করেতে বছরে খরচ হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। কোরবানির ঈদে এখনও পর্যন্ত ১৩টি গরু বিক্রি করেছি ১২ লাখ টাকায়। ৩-৪ লাখ টাকা দামের কিছু বড় গরু ঢাকায় পাঠিয়েছি বিক্রি করতে। আমি নিজে স্বাবলম্বী হওয়ায় এখন স্বপ্ন দেখি গ্রামের অসহায় ও দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার। গরুর খামারের পর ছাগল ও মুরগির খামার আগামী ২০২২ সালে শুরু করবো ইনশাআল্লাহ। এবার খামার থেকে ১৬-১৭ লাখ টাকা লাভ হবে গরু বিক্রি হলে। তাছাড়া প্রজেক্টটা আরও বড় করারও ইচ্ছা আছে। গরুগুলো আমি নিজে দেখাশুনা করি। গরুর দাম ভালো না পেলে ও বিক্রি না হলে লোকসান হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
মা নার্গিস আক্তারের কথা: আমি রান্না ঘরে রান্না করছিলাম। সেখানে ছোট হিরা বসেছিলো। অসাবধানতাবশত তার জামায় আগুন লেগে যায়। আগুনে তার শরীর পুড়ে যায়। চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, মেয়েকে বাঁচানো সম্ভব নয় বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গ্রামে এসে স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসকের কাছে এক মাস ১২ দিন চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তুলি। তারপর পড়াশুনা শুরু করে। পাশ করেছ এসএসসি, এইচএসসি। ভর্তি হয় কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজে অনার্সে। ২০১৭ সালের জুন মাসে পারিবারিকভাবে আলমডাঙ্গায় বিয়ে হয়। বিয়ের দুই মাস পর শরীরে পোড়া দাগ থাকার কারণে স্বামী ডিভোর্স দেয়। আমার হিরার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। কিন্তু আমার হিরার আলোয় সব অন্ধকার দূর হয়ে গেছে। হিরা আমাদের পরিবারে হিরার মতো মূল্যবান।
হিরা খাতুনের ছোটবোন অনার্স পড়ুয়া মীম বলেন, পরিবারের সব দায়িত্ব আমার মেজবোনের ওপর। তিনি ছেলের চেয়ে অনেক বেশি করেন। কারণ ভাই বিদেশ থাকে আর বাবা অসুস্থ। তিনি আমাদের পরিবারে বটগাছের মতো। বর্তমানে তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।
প্রতিবেশী তরুণী সাদিয়া আক্তার কণা জানান, হিরা আপা আমাদের মডেল। কঠোর পরিশ্রম করে কীভাবে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে হয় তিনি আমাদের শেখাচ্ছেন।
আলমডাঙ্গা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুল্লাহিল কাফি জানান, আলমডাঙ্গায় গরুর যতগুলো ফার্ম আছে তার মধ্যে তিনি একমাত্র সফল নারী উদ্যোক্তা। তিনি অনেক পরিশ্রম করেন। আধুনিক পদ্ধতি ও প্রাকৃতিক উপায়ে গরু পালন করেন। উপজেলার মধ্যে তিনি একমাত্র মহিলা গরু পালনকারী ও সফল উদ্যোক্তা।