আশ্রমে ভক্তনারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা :  আলমডাঙ্গার আলোচিত পান্টু হুজুরসহ গ্রেফতার ৩

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার এরশাদপুরের বহুল আলোচিত পান্টু হুজুরকে এবার সাগরেদের স্ত্রী হত্যা মামলায় গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ সময় পুলিশ আরও ২ আসামিকে গ্রেফতার করেছে। ইতোপূর্বে ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করা, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাসহ একাধিক অভিযোগে একাধিকবার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিলো। তাছাড়া ফুঁসলিয়ে অন্যের স্ত্রী, যুবতীদের নিজের আখড়ায় রাখা, যুবতীদের নিয়ে এসে গানের আসর বসানো, রোগ চিকিৎসার নামে প্রতারণা করার নানা অভিযোগেও ইতোপূর্বে পুলিশ তাকে আটক করেছিলো।
এজাহারসূত্রে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বাথানপাড়ার আব্দুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি অসুস্থ হলে তিনি নিজের বিধবা যুবতী কন্যা মুক্তামালাকে (৩২) নিয়ে আলমডাঙ্গার এরশাদপুর গ্রামের পান্টু হুজুরের দরবারে যান চিকিৎসা নিতে। ওই সময় পান্টু হুজুরের খাদেম হিসেবে পরিচিত এরশাদপুর গ্রামের ইছাহক আলীর ছেলে জহুরুল ইসলামের সাথে মুক্তামালার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরই এক পর্যায়ে ৬-৭ মাস পূর্বে তারা পরষ্পর বিয়ে করেন। বিয়ের পর মুক্তামালা স্বামীর সাথে পান্টু হুজুরের আশ্রমেই বসবাস করতেন। হুজুরের খাদেম হিসেবে ওই দরবার শরীফে আরও অনেক মেয়ে ও পুরুষ বসবাস করেন। বিয়ের পর থেকেই জহুরুলের মা জহুরা খাতুন বউমা মুক্তামালাকে ভালোভাবে নেননি। নানা অত্যাচার করতেন। খেতে দিতেন না। ঘরের ভেতর আটকে রাখতেন। ছেলে জহুরুল ও পান্টু হুজুরকে ফুঁসলাতেন। তারা সকলে মিলে মুক্তামালার ওপর অমানসিক অত্যাচার শুরু করতেন। এক পর্যায়ে গতকাল রোববার সকাল ৮টার দিকে মুক্তামালাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশের গলায় ওড়না পেচিয়ে পান্টু হুজুরের ঘরের আড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখে। পরে লাশ দরবারের নিজস্ব ভ্যানে করে বাপের বাড়ি গাংনী উপজেলার বাথানপাড়ায় পাঠিয়ে দেন। ঘটনাটি কাউকে না বলতে হুমকিও দেয়া হয়। পরে আত্মীয়-স্বজনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে আব্দুর রশিদ লাশ নিয়ে আলমডাঙ্গা থানায় উপস্থিত হন। পরে মুক্তামালার পিতা আব্দুর রশিদ বাদী হয়ে জহুরুল ইসলাম ও পান্টু হুজুরসহ ৪ জনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলা দায়েরের পর পুলিশ গতকালই এরশাদপুরের ইছাহকের ছেলে জহুরুল ইসলাম, জহুরুলের মা জহুরা খাতুন ও সালাউদ্দীন পান্টু হুজুরকে গ্রেফতার করে।
ইতোপূর্বেও পান্টু হুজুরকে পুলিশ একাধিকবার গ্রেফতার করে। ইসলাম ধর্মকে বিকৃত করা, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করা, ঈমান আকিদা নষ্ট হয় এমন বিষয় প্রচার-প্রচারণা চালানোসহ একাধিক অভিযোগে বাংলাদেশ ঈমাম সমিতির আলমডাঙ্গা উপজেলা শাখার সভাপতি প্রভাষক আব্দুর রহমান ভন্ডপীর পান্টুর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। ওই সময় অনেক আলেম ওলামা থানায় গিয়ে ভন্ডপীর পান্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে পান্টু নিজেকে আত্মার বিজ্ঞানী হিসেবে প্রচার করে আসছিলেন। তিনি নিজেকে বিশ্বসেরা আধ্যাত্মিক সাধক দাবি করে তাসাউফ বা তরিকত শিক্ষা দেয়ার নামে সাধারণ মানুষকে ঈমানহারা করার চক্রান্ত করেছে। আল্লাহকে নিজ চোখে দেখা, কথা বলা, আল্লাহকে দেখানো, মৃত ব্যক্তির আত্মার সাথে স্বজনদের কথা বলানোর দাবি করে তিনি বির্তকিত হন। তার আখড়াকে মুরিদ যুবতীদের হারেমখানায় পরিণত করারও অভিযোগ ওঠে। তিনি নিজেও নামাজ পড়েন না এবং তার মুরিদদেরকে নামাজ পড়তে নিষেধ করেন বলে দাবি করা হয়। কোরআন সংশোধনের দাবির মতো কবিরা গুনাহের অপরাধ করে আসছিলেন বলেও অভিযোগ করা হয়।
ওই সময় আলমডাঙ্গা থানার এসআই এমদাদ ও এসআই আফজাল সঙ্গীয় ফোর্সসহ এরশাদপুর গ্রামে পান্টু হুজুরের আখড়ায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে তাকে গ্রেফতার করেন। এ সময় ওই আখড়া থেকে বহু মহিলা ও যুবতী শিষ্যরা পালিয়ে যান।
গ্রামসূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন তার আখড়ায় শত শত নারী-পুরুষ ছুটে আসেন। এদের বেশীর ভাগই নারী। পান্টু হুজুরের আখড়ায় এ সকল মহিলা ও যুবতীরা দিনের পর দিন অবস্থান করে বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়টি অনেকেই বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। এতে বহু সংসার ভেঙে গেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গোবিন্দপুরের বারি শেখের ছেলে টিপু রাতে দীর্ঘদিন বাড়ি না থেকে আখড়ায় অবস্থান করেন। এতে তার সংসারে জ্বলছে অশান্তির আগুন। এরকম বহু যুবক স্ত্রীসঙ্গ ত্যাগ করে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করেছে। এরশাদপুর গ্রামের এক সময়ের শিষ্য খাদেমুল, হায়দার আলী, নজরুলসহ বহু যুবকের জীবনে পান্টু হুজুর অশান্তির আগুন জ্বেলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরশাদপুর গ্রামের নুরুদ্দিনের ছেলে জাইদুল পান্টুর শিষ্য। তার চোখে সমস্যা ছিলো। চোখের রোগের কারণে তিনি পান্টুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আলমডাঙ্গা পোস্ট অফিসে তার নামে ১৩ হাজার টাকা ছিলো। বিষয়টি জানতে পেরে পান্টু হুজুর তার অপর শিষ্য বিনোদপুর গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে আব্বাসকে দিয়ে অবৈধভাবে প্রতারণা করে উত্তোলন করেন। বিষয়টি জাইদুল জানতে পারলে এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে টাকা ফেরত পেতে চেষ্টা করেন। আব্বাস কিংবা পান্টু হুজুর টাকা ফেরত না দিলে আলমডাঙ্গার পোস্টমাস্টার নিজের বেতন থেকে সেই টাকা পরিশোধ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েকদিন পুর্বে ইবি থানার রাধানগর গ্রামের এক কৃষক থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন পান্টু হুজুরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিলো তার স্ত্রী পান্টু হুজুরের কাছে যাওয়া-আসার একপর্যায়ে আর ফিরে যাচ্ছে না। তার দাম্পত্য জীবনও শেষ হয়ে গেছে। তার স্ত্রী আর তার সাথে সংসার করতে চাচ্ছে না। প্রতি মাসের ৫ তারিখে তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতীদের নিয়ে এসে গানের আসর বসান। তিনি আসরে উপস্থিত অনেকেই দুই হাতে টাকা ছিটান। গতকাল সন্ধ্যায় পান্টু হুজুর গ্রেফতারের পর এ ধরণের নানা অভিযোগ নিয়ে বহু মানুষ একদিকে যেমন সোচ্চার ছিলেন তেমনই আনাগোনা ছিলো পান্টু হুজুরের প্রভাবশালী দালালদের। জ্বীনের সাহায্যে পান্টু হুজুর ক্ষতি করতে পারেন এমন ভয়ে অনেকেই মুখ না খুললেও অনেকে জানিয়েছেন নানা কাহিনী। অনেকে দাবী করে বলেছেন, ন্যাড়া ফকিরদের মতো পান্টু হুজুর বীর্যপতন রোধ করতে পারেন। ওই কারণে মহিলারা তার প্রতি অনেক আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এটাকে তিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে প্রচার করে ফায়দা লুটেন।
২০০৭ সালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছিলো। ওই সময় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ছাড়া পায় পান্টু হুজুর। ছাড়া পাওয়ার পর পুনরায় পীরত্বের ব্যবসায় ফিরে গিয়ে নতুন নতুন প্রতারণা শুরু করেন। তিনি প্রচার করতে থাকেন তার অলৌকিক ক্ষমতার মিথ্যা কাহিনী। তাকে কেউ গ্রেফতার করে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তাকে দেখে বিচারকের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সে কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অনেকেই ভন্ডপীর আখ্যায়িত করে পান্টু হুজুরের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন।
২০০৭ সালে গ্রেফতারের পর তাকে আলমডাঙ্গা থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তিনি সবগুলো কালেমা, আয়াতুল কুরছি বলতে পারেননি। ইসলামের মূলনীতিগুলো সম্পর্কে তার ধারণা নেই। তৎকালীন কুমারী ইউপি চেয়ারম্যান মাও. আব্দুল কাদের বলেন, পান্টু ইসলাম ধর্মের ব্যাপক ক্ষতি করছে। তিনি ইসলাম সমর্থন করেন না। এমন ইসলাম বিরোধী বিষয়গুলো ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এটা অনেক বড় অপরাধ।
গ্রামসূত্রে জানা গেছে, পান্টু হুজুর অনেক জায়গা জমি কিনেছেন। একেবারে দরিদ্র পরিবারের ছেলে হলেও তিনি ভন্ড হুজুর সেজে আখড়া তৈরি করে মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে এখন কোটিপতি। হাটবোয়ালিয়া গ্রামে তার বোন জামাই জামাল হুজুরের মাধ্যমে হাটবোয়ালিয়া হাইস্কুল মার্কেটে তিসি একবারে ১২ লাখ টাকায় ৬টি দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন। এছাড়া তিনি একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনেছেন বলে এলাকাসূত্রে জানা গেছে।

 

Comments (0)
Add Comment