চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের উথলীতে দিন দুপুরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফিল্মি স্টাইলে সোনালী ব্যাংকে লুট

বিস্তারিত

এমআর বাবু/সালাউদ্দীন কাজল: চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাতদল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফিল্মি স্টাইলে প্রায় ৯ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। উপজেলার উথলী সোনালী ব্যাংক শাখায় গতকাল রোববার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকতাগণ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৩ জনকে আসামি করে জীবননগর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে এ ঘটনার পর উথলী এলাকাজুড়ে সাধারাণ মানুষের ভেতর চরম ডাকাতি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
পুলিশ, ব্যাংক স্টাফ ও প্রত্যক্ষদর্শীসূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার বেলা সোয়া ১টার সময় প্রথমে একজন পিপিই ও হেলমেট পরিহিত অবস্থায় উথলী বাজারে অবস্থিত সোনালী ব্যাংকের ভেতর প্রবেশ করে। এর ১ মিনিট পর আরও দু’জন হেলমেট পরিহিত অবস্থায় ব্যাংকের ভেতরে আসে। এরপর তারা ৩ জন পিস্তল উচিয়ে ব্যাংকের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরীসহ সবার মুঠোফোনগুলো নিয়ে নেয়। এরপর ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও নিরাপত্তাকর্মীসহ ওই ব্যাংকে কর্মরত মোট ৮ জনকে একটি কক্ষের সামনে বসিয়ে রাখে। পরবর্তীতে তারা ব্যাংকের ভোল্টে রক্ষিত টাকাসহ কাউন্টারে থাকা মোট ৮ লাখ ৮২ হাজার ৯শ’ টাকা লুট করে নেয়। টাকা লুটের পর ডাকাতদলের সদস্যরা দ্বিতীয় তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জরুরি সতর্ক সংকেত (ইমারজেন্সি হুইসেল) বাজান। সতর্ক সংকেত শুনে ব্যাংকের পার্শ্ববর্তী দোকানদাররা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন এবং ডাকাতদলকে ধাওয়া করেন। এ সময় ডাকাতদল পিস্তল উচিয়ে গুলি করার হুমকি দিলে দোকানদাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং চিৎকার শুরু করেন। এই সুযোগে ডাকাতদল ব্যাংকের পেছনে রেখে দেয়া লাল রঙের হিরোহোন্ডা মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্ট করে। পালিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতদল উথলী সূর্য তরুণ ক্লাবের সামনে গেলে আবারও বাধাঁর মুখে পড়ে। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা আরিফুর রহমান মন্টুসহ ৫-৬ জন মোটরসাইকেল লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে একটি ইট ডাকাত দলের হেলমেটে লাগে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপার

খবর পেয়ে উথলী বিশেষ ক্যাম্পের বিজিবি সদস্য ও জীবননগর থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ডাকাতদলের ফেলে যাওয়া পিস্তলের অংশ বিশেষ উদ্ধার করেছে। ঘটনার পর খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি ক্রাইম) মো. নাহিদুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার, চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম, জীবননগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজি মো. হাফিজুর রহমান, জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মুনিল লিংকন, চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (দামুড়হুদা সার্কেল) আবু রাসেল, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) উপপরিচালক জিএম জামিল সিদ্দিক, সোনালী ব্যাংকের ফরিদপুর জিএম অফিসের জেনারেল ম্যানেজার (ইনচার্জ) খোকন চন্দ্র বিশ্বাস, সোনালী ব্যাংকের চুয়াডাঙ্গার প্রিন্সিপাল অফিসার ব্যবস্থাপক খন্দকার আবুল কালাম আজাদ, সহকারী ব্যবস্থাপক আনিসুর রহমান, জীবননগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামসহ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), ডিজিএফআই, ডিএসবি ও সিআইডির উর্র্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
এ ঘটনায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বাদী হয়ে রাত ১০টার সময় জীবননগর থানায় অজ্ঞাত ৩ জনকে আসামি করে একটি ডাকাতি মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঘটনার সময় টাকা জমা দিতে যাওয়া ওই ব্যাংকের গ্রাহক এনামুল হক এবং আনিছুর রহমানকে জীবননগর থানায় নিয়েছেন। এদিকে এ ঘটনার পর উথলী এলাকাজুড়ে সাধারাণ মানুষের ভেতর চরম ডাকাতি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়া এনামুল হক জানান, ৩ জন এসে প্রথমে ব্যাংকের প্রধান ফটকে একজন দাঁড়ায়। তারপর অন্য দু’জন পিস্তল উচিয়ে বলে কেউ চিল্লা-চিল্লি করবা না তাহলে কিন্তু গুলি করে দেবো। এরপর তারা টাকাগুলো লুট করে পালিয়ে যায়।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ব্যাংকের পাশের কাপড়ের দোকানদার নুরুজ্জামান হক লিটন জানান, ইমারজেন্সি হুইসেল শুনে তিনি দ্রুত ব্যাংকের দিকে ছুটে যান। এ সময় ডাকাতদল পিস্তল উচিয়ে তার দিকে তেড়ে আসলে তিনি চিৎকার দিতে দিতে সটকে পড়েন।
চিৎকার শুনে সূর্য তরুণ ক্লাবের সামনে অবস্থান নেয়া আরিফুর রহমান মন্টু বলেন, ডাকাতরা মোটারসাইকেল করে পালিয়ে যাওয়ার সময় অমরা ৫-৬ জন তাদের ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করি। এ সময় ডাকাতদল আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে উদ্যোত হলে আমরা তাদের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করি। একটি ইট মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা ডাকাতদলের সদস্যের হেলমেটে লাগে।
ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরী জাফর হোসেন বলেন, প্রথমে একজন হেলমেট পরিহিত অবস্থায় এসে আমার কপালে পিস্তল ধরে আরেকজন এসে গলায় ছুরি ধরে বলেন, কথা বল্লে খুন করে ফেলবো। এরপর তারা আমাদের সবাইকে একত্রিত করে ডাকাতি শুরু করে।
ওই ব্যাংকের হিসাবরক্ষক (ক্যাশিয়ার) সামিউল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের ভেতরে ডাকাতদল প্রবেশ করে সবার মোবাইলফোনগুলো কেড়ে নিয়ে বলে কোনো কথা হবে না। তারা পিস্তল ধরে ব্যাংকের সবাইকে এক জায়গায় বসায়। এরপর তারা আমাকে ভোল্ট খুলতে বলে। ভোল্টে থাকা টাকাগুলো নেয়ার পর কাউন্টারে থাকা টাকাগুলোও নিয়ে নেয়।
ব্যাংকের ব্যাবস্থাপক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, তিনজন এসে প্রথমে আমাদের মোবাইলফোন কেড়ে নিলো এবং ব্যাংকের দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর অস্ত্র তাক করে আমাদের সবাইকে একত্রিত করে। তারপর ক্যাশিয়ারকে ডেকে নিয়ে গ্রাহকের জমা দেয়া টাকাসহ সমস্ত টাকা লুট করে নেয়। মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিটের ভেতর তারা সমস্ত কাজ শেষ করে।
জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মুনিম লিংকন বলেন, ডাকাতদল পিপিই পরে অভিনব কায়দায় অল্প সময়ের মধ্যে ক্যাশ কাউন্টার থেকে পৌনে ৯ লাখ টাকা লুট করেছে। আমরা খবর পেয়ে দ্রুতই ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। লুট হওয়া টাকা উদ্ধারে পুলিশ জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে যতোগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক আছে তার মধ্যে সোনালী ব্যাংক অন্যতম। এ ব্যাংকে যে ক্রাইমটা হয়েছে সেটি হাইলি ইম্পটেন্সি। আমরা এখানে ছুটে এসেছি। আমাদের শাদা পোশাকের পুলিশ, ডিবি পুলিশ এবং পোশাকধারী পুলিশ ইতোমধ্যে আসামিদের ধরতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। আমরা আশাবাদী দ্রুতই টাকা উদ্ধারসহ আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, বর্তমান যুগে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না। কারণ সবাই জানে এখন ইনফরমেশন টেকনোলজি খুবই শক্ত। লুট হওয়া টাকা উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা মাঠে কাজ করছে। আশাকরি খুব দ্রুত তারা আসামিদেরকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে।
পুলিশের খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি ক্রাইম) মো. নাহিদুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক চালানোর জন্য এ ভবন মোটেও উপযুক্ত না। আজকের এ ঘটনা আমাদের জন্য অনাকাক্সিক্ষত। আমার ধারণা এ জেলার মধ্যেই অপরাধীদের অবস্থান। আমরা আশাবাদী অল্প সময়ের মধ্যে আসামি ধরতে পারবো। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি আছে। ব্যাংকের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটা সিসি ক্যামেরাও নেই; বর্তমান যুগে এটা ভাবা যায় না।

Comments (0)
Add Comment