পঞ্চাশের দশকে চৌরিঘর থেকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়টি

কার্পাসডাঙ্গা হাইস্কুলে ভর্তি হওয়া প্রথম নারী শিক্ষার্থী রহিমা খাতুনের বয়স এখন ৭১ বছর

রতন বিশ্বাস: দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে উঠে আসা এলাকার মানুষের উদ্যোগে ও স্বেচ্ছাশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়। চৌরি বাংলাঘর দিয়ে বিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হলেও আজ নির্মিত হয়েছে আধুনিক ভবন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ঐতিহাসিক এলাকা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে ছিলো পিছিয়ে। এখানে পাকিস্তান আমলে ১৯৫৩ সালের শেষদিকে স্থানীয় মাতব্বর, বিদ্যানুরাগী ও সমাজসেবীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ওই বৈঠকে কার্পাসডাঙ্গায় একটি জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
বিভিন্নভাবে জানা গেছে এলাকার প্রয়াত হাজি তালেব আলী ম-ল, হাজি গহর আলী মালিতা, তৎকালীন কার্পাসডাঙ্গা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট শ্রী অজিত কুমার ম-ল, দামুড়হুদা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এম মফিজুর রহমান, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. নজির আহমদ বিশ্বাস, সাবেক চেয়ারম্যান নসকর আলী, আপেল উদ্দিন ম-ল, আজগার আলী বিশ্বাস, মোক্তার আলী বিশ্বাস, ওসমান গনি, উম্বর আলী, ডা. দীন মোহাম্মদ, দীলু ম-ল, ভোলাই মিয়া, গোলাম রহমান মালিতা, শরিফুতুল্লাহ মল্লিক, সোবেদার হোসেন প্রমুখ ব্যক্তি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে পার্শ্ববর্তী ভনু ম-লের পান্থশালায় ১০-১২ জন ছাত্র নিয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণি খোলা হয়। সে সময় পান্থশালার বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন নবাই বিশ্বাস, সম্মথ দত্ত, তিলত ম-ল ও গেটর বাবু। পরে বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গভাবে শুরু হলে শিক্ষকতা করেন মৃত জালাল উদ্দিন, সোবেদার হোসেন, ছহিরুদ্দিন বিশ্বাস, আব্দুল ওহাব, হাতেম আলী, মাহবুব হোসেন, নজির আহমদ, হাজি আরজুল্লাহ, আবুল কাশেম, গোলাম মোস্তফা, আবদুল আজিজ, সেকেন্দার আলী, তোফায়েল হোসেন, আশরাফ আলী, আব্দুল মজিদ, খলিলুর রহমান, ফজলুর রহমান ও ডা. কোবাদ আলী। পরের বছর স্থানীয়দের চাঁদার ভিত্তিতে একটি চৌরি বাংলা ঘর উঠিয়ে ৭ম ও ৮ম শ্রেণি চালু করা হয়। সামাজিক নিন্দার ভয়ে প্রথমে কোনো নারী শিক্ষার্থীকে এ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হতো না। বিষয়টি অনুধাবন করেন কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের একাধিকবারের চেয়ারম্যান বিদ্যানুরাগী প্রয়াত নসকর আলী। তিনি সামাজিক দৃষ্টিকোণ বদলে দিতে এবং নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার তাগিদে ১৯৬২ সালে নিজের প্রথম কন্যাসন্তান মোছা. রহিমা খাতুনকে কার্পাসডাঙ্গা হাইস্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করান। ফলে কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ভর্তিকৃত নারী শিক্ষার্থী মোছা. রহিমা খাতুন। সে সময় কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে এলাকাবাসীর সহযোগিতা ছাড়াও মেলা, যাত্রা, থিয়েটার, সার্কাস ও ম্যাজিকের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হতো।
জানা যায়, কার্পাসডাঙ্গায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলে ১৯৬৮ সালে কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের উম্বর আলী ২৮ শতক ও পরে ১৯৭২ সালে কার্পাসডাঙ্গা বাজারপাড়ার সমাজ সেবক ও দানশীল ফকির মোহাম্মদ বিদ্যালয়ের নামে মাঠের ৫ বিঘা জমি দান করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৮, ৬৯, ৮০ ও ৮৭ সালে পর্যায়ক্রমে বিদ্যালয়ের ভবন সম্প্রসারণের কাজ করা হয়। ১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি অনুমোদন লাভ করে। ১৯৭৫ সালে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। ৬০ এর দশকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মুজিবনগর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের ফজলুর রহমান। এরপর দামুড়হুদা উপজেলার জুড়ানপুর গ্রামের কৃতিসন্তান বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক এমএ বকর ১৯৭৩ সালে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম ছাত্রী রহিমা খাতুনের বয়স এখন ৭১ বছর। তিনি জানান, ‘আমি ১৯৬২ সালে স্থানীয় কোমরপুর প্রাইমারি স্কুল হতে ৫ম শ্রেণিতে ফার্স্ট হই। ওই বছর আব্বা আমাকে কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। তখন সমালোচনার ভয়ে এলাকার কোনো পরিবার মেয়েকে হাইস্কুলে ভর্তি করাতে চাচ্ছিল না। আমাদের কোমরপুর গ্রাম থেকে নৌকায় ভৈরব নদ পার হয়ে হাইস্কুলে যেতাম। আমার ক্লাসে ১২ জন ছেলে আর আমি একা মেয়ে পড়ালেখা করতাম। মনে আছে স্কুলে ক্লাস শেষ করে স্যারের সাথে আবার অফিস কক্ষে চলে যেতাম। আবার স্যারের সাথে ক্লাসে আসতাম। তবে ৩ বছর পর আমি স্কুল থেকে চলে আসি। এর পরে কিছ কিছুু মেয়ে স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে। আমার সময়ে পিরোজপুর গ্রামের ফজলুর রহমান প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার নিজ গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিলো ১৪-১৫ কিলোমিটার। তাছাড়া কাঁচা রাস্তা। বাড়ি থেকে আসা যাওয়ায় অসুবিধা বলে তিনি তার পরিবারসহ আমাদের বাড়িতে থাকতেন। সহকারী শিক্ষক ছিলেন আশরাফ আলী। আর অঙ্কেরশিক্ষক ছিলেন কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের খলিলুর রহমান। ৩ বছর ছাত্রী হিসেবে স্কুলে আমি একা ছিলাম। আমাদের শ্রেণিকক্ষের ছাউনি ছিল খড়ের। তাতে কোনো দেয়াল ছিলো না। চারপাশ ছিলো ফাঁকা। অফিসটি ছিলো ইটের দেয়াল ও ওপরে টালি। সবকিছুই মনে আছে সেই ৬০ দশকের স্মৃতি।’
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা তৎকালীন নদীয়াা জেলার চাপড়া থানার পিপড়াগাছির একাধিকবারের বোর্ড প্রেসিডেন্ট হাজি তালেব আলী ম-লের নাতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমার দাদা এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। বোর্ড থেকে যখন বিদ্যালয় অনুমোদনের জন্য টিম আসে তখন তারা অনুমোদন না দিলে নিজেদের খরচে বিদ্যালয় চালানোর ঘোষণা দেন তাদের সামনে। আমার দাদার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রতিষ্ঠানে। পরে আমার বাবা ফকির মোহাম্মদ স্কুলের নামে মাঠের ৫ বিঘা জমি দান করেন। কার্পাসডাঙ্গা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নামে আমার বাবা ও বাবার ফুফু পাচিরন নেছা বিবি দুজন মিলে এক একর জমি দান করেন।’
এদিকে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে জমি দানকারী উম্বর আলীর নাতি দোস্ত মোহাম্মদ ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘বিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম আমার দাদা ২৮ শতক জমি দান করেন। জমি দান করে আমার দাদা সে সময় বিদ্যালয়ের বারান্দায় শুয়ে রাত দিন কাটাতেন। তখন আমার দাদান্দ্রুব অভাবে দিন কেটেছে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এম মফিজুর রহমান ও প্রয়াত সাবেক চেয়ারম্যান নসকর আলী আমার দাদাকে খুব ভালোবাসতেন এবং দেখাশোনা করতেন। তবে এখন খুব দুঃখ পাই, আজকের কার্পাসডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠান হলে আমাদের কাছে চিঠি আসে না। বাপ-দাদারা বিদ্যালয়ের জন্য জমি দান করা সত্ত্বেও আমাদের প্রতিষ্ঠানে ডাকা হয় না।’ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শওকত আলী জানান, ‘ষাটের দশকে এই প্রতিষ্ঠানে আমি সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলাম। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান ট্রেনিংয়ে গেলে আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পাই। প্রতিষ্ঠানে প্রথম এসএসসি পরীক্ষা হয় আমার সময়ে।

Comments (0)
Add Comment