পরমাণু চুক্তি না করলে যেকোনো সময় ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা হোয়াইট হাউজে আলোচনা : শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলাতে পারে

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইরানে যে কোনো সময় হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলার অনুমোদন দিয়েছেন। তবে ইরান পরমাণু চুক্তি করলে হামলা চালানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে পারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন হামলার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীও সেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন। হোয়াইট হাউজে চলছে শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতি। ওয়াশিংটনের আকাশে ডুমস ডে বিমানের চক্করও প্রস্তুতির বার্তা দিচ্ছে। রাশিয়া, চীন ও ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রকে এই হামলা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ইরান ও ইসরাইলের পালটাপালটি হামলা অব্যাহত আছে। দুই দেশই উভয়ের পরমাণু স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। ইরান ও ইসরাইল সংঘাতের সপ্তম দিন বৃহস্পতিবার একে অপরের উপর পালটাপালটি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলার কথা ভাবছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিলের শর্তে ট্রাম্প হামলা শুরুর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে পারেন। মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে হামলার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন, কিন্তু হামলা চালানো হবে কিনা, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি বলে জানিয়েছে সিবিএস টেলিভিশন। ইরান যদি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল করতে রাজি হয়, তবে ট্রাম্প হামলা শুরুর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখবেন বলে একজন জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা সূত্র সিবিএসকে জানিয়েছে। এই খবরটি প্রথম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশ করা হয়। বুধবার ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে কিনা এমন প্রশ্নে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি এটা করতে পারি, আমি নাও করতে পারি।’ এর আগে সিবিএন জানিয়েছে, ইরানের ভূ-গর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা ফোর্দোতে মার্কিন হামলার কথা ভাবছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। আমেরিকা গতকাল পর্যন্ত সাইপ্রাসে যুক্তরাজ্যের ঘাঁটি বা ডিয়েগো গার্সিয়াকে কোনো সম্ভাব্য হামলায় ব্যবহার করার জন্য বলেনি বলে জানিয়েছেন বিবিসির সংবাদদাতা জোনাথন বিল। ইরানিরা বলেছে তারা হোয়াইট হাউজের দরজায় ঝুঁকবে না।
চলতি সপ্তাহেই হামলা হতে পারে: ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই (যুক্তরাষ্ট্রের রীতি অনুসারে, রবিবার সপ্তাহের শেষ দিন) যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালাতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আলোচনা চলছে। শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বদলানো হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা ব্লুমবার্গকে বলেছেন, সব ধরনের বিকল্প পথই খুলে রাখা হচ্ছে। আরেকটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, ট্রাম্প তার ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, তিনি ইরানের উপর সামরিক হানা চালাতে চান। তবে তার আগে তেহরানকে ওয়াশিংটন কিছুটা সময় দিতে চান। প্রতিবেদন অনুসারে, আমেরিকা দেখতে চায় যে তাদের কথা মতো ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করছে কিনা। এই পরিস্থিতির উপর নজর রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও ইরান বারবার অস্বীকার করছেন যে তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইসরাইলের অংশীদারিত্বের প্রশংসা করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, তিনি এটাকে অবিশ্বাস্য বলে অভিহিত করেছেন।
‘ডুমস ডে’ বিমানের চক্কর: ওয়াশিংটনের আকাশে চক্কর দিয়েছে ‘ডুমস ডে’ বিমান। জানা যায়, লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের বার্কসডেল সেনা ঘাঁটি থেকে মার্কিন সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা ছয়টায় উড্ডয়ন করে বিমানটি। ওয়াশিংটনের আকাশে চক্কর দেয়ার পর রাত ১০টা নাগাদ ভার্জিনিয়া এবং নর্থ ক্যারোলিনা সীমান্ত ঘুরে অ্যান্ড্রুজ জয়েন্ট বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করে। সাধারণত পারমাণবিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বা দেশের জরুরি অবস্থা তৈরি হলে দেখা মেলে এই বিমানের। এটি কার্যত ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধকক্ষের মতো। কমান্ডিং সেন্টারের রূপ নেয়। হামলার আশঙ্কা থাকলে এই বিমানে চড়ে আকাশপথে ঘোরাফেরা করেন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ থেকে সেনাপ্রধাসহ অন্যান্য কমান্ডাররা। সেখানে বসেই ঠিক হয় যুদ্ধের কৌশল। যোগাযোগ করা হয় অন্য রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে। আবার এবার বিমানটির জন্য যে সংকেত ব্যবহার করা হয়েছে তা আগে কখনো হয়নি। এতদিন বিমানটিকে ডাকতে ‘অর্ডার সিক্স’ সংকেত ব্যবহার করা হতো। এবার ব্যবহার করা হয়েছে ‘অর্ডার ওয়ান’। এর আগে ১৯৯৫ সালে হারিকেন ঝড়ের সময় এবং ২০০১ সালে নাইন ইলেভেন হামলার পর।
ইসরাইলে ইরানের হামলায় যা হয়েছে: দক্ষিণ ইসরাইলের বেয়ারশেবার সোরোকা হাসপাতাল ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই হামলার ফলে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির অস্তিত্ব আর থাকতে দেয়া যাবে না। ইরান বলেছে, তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল হাসপাতালের কাছে থাকা একটি সামরিক স্থাপনা। ইসরাইলের বেশ কয়েকটি এলাকায় রাতভর হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছেন। এদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইরানি জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, যদি শত্রু বুঝতে পারে যে আপনি তাদের ভয় পান, তাহলে তারা আপনাকে ছেড়ে দেবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এর একটি পোস্টে তিনি বলেছেন, এখন পর্যন্ত আপনাদের যে আচরণ ছিল তা চালিয়ে যান; শক্তি নিয়ে এই আচরণ চালিয়ে যান। ইসরাইলের সঙ্গে ছয় দিনের যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়েছিল আরব দেশগুলো। অর্থাৎ সিরিয়া, মিশর ও জর্ডান। সেটা ঘটেছিল ১৯৬৭ সালের জুনে। ঠিক ৫৮ বছর পরের জুনে যেন সেই ‘কলঙ্ক’ মুছল ইরান। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে চলমান ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ সপ্তম দিনে গড়িয়েছে।
ইরানে যা হয়েছে: ইসরাইলি বাহিনী বলেছে, ইরানের আরাক পারমাণবিক চুল্লি ও নাতাঞ্জসহ বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে তারা। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে এসব হামলার কথা জানিয়েছে ইরান। ইরানের তেহরানসহ বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক হামলা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ইসরাইলি বিমান বাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে তেহরান এবং অন্যান্য এলাকায় ধারাবাহিক হামলা শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে। তবে হামলার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে আরও বিস্তারিত কিছু জানায়নি ইসরাইলি বিমান বাহিনী। ইসরাইলি সেনাবাহিনী সামরিক অবকাঠামো টার্গেট করার আগে ইরানের আরাক এবং খান্দাবের বাসিন্দাদের ওই এলাকা থেকে সরে যেতে সতর্কতাও জারি করেছিল।
কূটনৈতিক সমাধান চান পুতিন-জিনপিং: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ফোনালাপে ইরানের ওপর ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। একইসঙ্গে দুই নেতা এই সংঘাতের কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। ক্রেমলিনের সহযোগী ইউরি উশাকভ সাংবাদিকদের বলেন, উভয় পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি একই। তারা ইসরাইলের কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে এই শত্রুতার অবসান ঘটানো উচিত বলে মনে করেন তারা। এর আগে গতকাল পুতিন সেন্ট পিটার্সবার্গে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠকে ইসরাইল ও ইরানের সংঘাত নিয়ে কথা বলেছেন। ইরান রাশিয়ার সাহায্য চেয়েছে কিনা, বার্তা সংস্থা এএফপি এমন বিষয় জানতে চাইলে পুতিন উত্তর দেন, আমাদের ইরানি বন্ধুরা আমাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা (সাহায্য চায়নি) করেনি। এদিকে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির সম্ভাব্য হত্যাকান্ড নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, আমি এ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই না। এর আগে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, আমেরিকার হস্তক্ষেপ পরিবেশকে আরেকটি ভয়াবহ উত্তেজনার দিকে নিয়ে যাবে এবং বিশ্বকে বড় ধরনের বিপর্যয় তথা অস্থিতিশীলতার দিকে যাবে। ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ থেকে সরে আসতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার। তিনি বলেছেন, এখানে সংঘাত বৃদ্ধির বড় ঝুঁকি রয়েছে। তিনি সব পক্ষকে কূটনৈতিক সমাধান খোঁজার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আজ জেনেভায় বৈঠকে বসছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কালাসের সঙ্গেও তার দেখা করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ।