স্টাফ রিপোর্টার: বর্তমান সময়ে দাম্পত্য বিচ্ছেদ কিংবা সংসারের অশান্তি ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের পরিচয় দিতে একসাথে জীবন দেয়ার ঘটনা বিরল। এমনই এক ঘটনা এলাকার মানুষকে হতবাক করেছে। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটি মেহেরপুরের গাংনী পৌরসভার চৌগাছা গ্রামে। বিদ্যুতায়িত স্বামী গোলাম কিবরিয়াকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন স্ত্রী রিনা খাতুন। গতকাল সোমবার বিকেলে নিজ বাড়িতে মর্মান্তিক এ জোড়া মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গোলাম কিবরিয়া (৫০) চৌগাছা গ্রামের মান্নাফ আলিফ ছেলে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোলাম কিবরিয়ার বাড়িতে বৈদ্যুতিক মিটারের আর্থিং তারের সাথে বাইসাইকেল রাখা ছিলো। আর্থিং তারের সাথে বাড়ির সাইড লাইনের সংযোগ হয়ে যায়। গোলাম কিবরিয়া নিজের অজান্তে বাইসাইকেল ধরার সাথে সাথে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েন। বিষয়টি টের পেয়ে তাকে বাঁচাতে ছুটে যান তার স্ত্রী রিনা খাতুন। স্বামীকে টেনে সরিয়ে দেয়ার সময় রিনা খাতুনও বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েন। এ সময় তাদের ছোট মেয়ে চিৎকার দিয়ে আশেপাশের লোকজনকে জানায়। পথচারীরা ছুটে গিয়ে গোলাম কিবরিয়া ও তার স্ত্রীকে উদ্ধার করে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। এ সময় দায়িত্বরত চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজমিস্ত্রী গোলাম কিবরিয়া তিন কন্যা সন্তানের জনক। এর মধ্যে বড় মেয়ে বিবাহিত এবং প্রাথমিকের শিক্ষক। মেজো মেয়ে অনার্সে এবং ছোট মেয়ে মাধ্যমিকের ছাত্রী। রাজমিস্ত্রীর কাজ করেও তিনি মেয়েদেরকে লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছেন। দারিদ্রতার কষাঘাতের মধ্যেও মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর দুজনেই ছিলেন বেশ সচেতন। বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ বেশ আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পাশের বাড়ির থেকে সাইড কানেকশন নিয়ে বাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতেন। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও আর্থিং তার আগের মতোই রয়েছে। সাইড কানেকশনের তার বাড়ির মেইন সুইচের সাথে দেয়া হয়। এতে নিয়ম অনুযায়ী আর্থিং তার কিছুটা বিদ্যুৎ পরিবাহী হয়ে পড়ে। গতকাল সোমবার সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে আর্থিংয়ের ওই তার সাইড কানেকশনের কারণে বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়ে। যা কোনভাবেই সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। গোলাম কিবরিয়ার বাড়ির দেয়ালের আর্থিং তারের সাথে বাইসাইকেল রাখা ছিলো। গোলাম কিবরিয়া স্বাভাবিকভাবেই বাইসাইকেল নিতে গিয়েছিলেন। আর এতেই ঘটে বিপত্তি।
স্বামী স্ত্রীর দুজনকে উদ্ধারকারী কানন নামের এক যুবক জানান, তিনি গাংনী থেকে মোটরসাইকেলযোগে চৌগাছার দিকে যাচ্ছিলেন। গোলাম কিবরিয়ার বাড়ির সামনে গিয়ে শুনতে পান একটি মেয়ে চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। তখন আশেপাশের কয়েকজনকে সাথে নিয়ে তিনি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেন। তারা দেখতে পান স্বামী-স্ত্রীর দুজনেই একসাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। বিদ্যুতায়িত হয়েছে বলে নিশ্চিত হন ওই যুবকরা। এ সময় তারা বাড়ির মেন সুইচ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। স্বামী স্ত্রী দুজন বেঁচে আছে মনে করে তারা একপ্রকার ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারে নেমে পড়েন। প্রথমে বাঁশের খুঁটি এবং পরবর্তীতে কাপড় দিয়ে পা বেঁধে টেনে দূরে সরিয়ে আনেন। স্থানীয় আরও মানুষ সেখানে জোড় হয়। দ্রুত স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে হাসপাতালে পৌঁছানোর বেশ আগেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়ে দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
এদিকে স্বামী স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রতিবেশী স্বজন ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী পুরুষ ভিড় করেন ওই বাড়িতে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শেষ দর্শন পেতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন এসব মানুষ। একই সাথে স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য সৃষ্টি হয়। কিবরিয়া এবং রিনা খাতুন এর সন্তান ও স্বজনদের আহাজারি যেন কিছুতেই থামছে না। স্বজনদের মধ্যেও কান্নার রোল পড়েছে। এই দৃশ্য দেখে উৎসুক মানুষের অনেকেই ফেলেছেন চোখের পানি। স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রীর প্রাণ বিসর্জন এটি নিদর্শন হয়ে থাকবে বলে জানালেন উৎসুক মানুষের অনেকে। গোলাম কিবরিয়ার পরিবারে অভাব থাকলেও স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া এবং পারস্পারিক শ্রদ্ধা ভালোবাসার যে ঘাটতি ছিল না তা প্রমাণ করে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। দাম্পত্য কলহ আর বিবাহ বিচ্ছেদ এখন অহরহ করে চলেছে। এর বিপরীতে স্বামীর জন্য স্ত্রীর জীবন বিসর্জন স্বামীর প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য নজির।
এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাদের বিদেহ আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন উপস্থিত সকলে। একই সাথে তার তিন কন্যা সন্তানদের দেখভালের জন্য রাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ রাখেন তারা। অপরদিকে দুর্ঘটনা এড়াতে পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের আগে থেকে কোনো কিছু করণীয় ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখার দাবি উঠেছে। তবে এ বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাত ৯টার দিকে চৌগাছা কেন্দ্রীয় গোরস্থানে স্বামী স্ত্রীর মরদেহ দাফনের জন্য কবর খোঁড়া চলছিলো। কিবরিয়ার স্বজন এবং গ্রামের মানুষ বিশেষ ব্যবস্থায় বৃষ্টি উপেক্ষা করে কবর খোঁড়ার কাজ করছেন। ঘটনার সময় থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এই সংবাদ লেখার সময়ে মাঝারি বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। রাতেই তাদের দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।