সাভারের ৩ ছাত্র হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল, হাসিনাসহ অভিযুক্ত ২০৮

ফ্যাসিস্ট বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আশুলিয়া থানা এবং সাভার মডেল থানায় দায়ের হওয়া ৩টি মামলার পুলিশ প্রতিবেদন (চার্জশিট) আদালতে দাখিল করা হয়েছে। চার্জশিট দাখিল করা মামলা তিনটির মধ্যে একটি সাভার মডেল থানায় ও ২ টি আশুলিয়া থানায় দায়ের করা হয়েছিল।

শনিবার সকালে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবীর এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। প্রায় ১ বছর তদন্তের পর এই তিন মামলার প্রতিবেদন দাখিল করল পুলিশ।

তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার এই মামলা গুলোর চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।

সাভার মডেল থানার তথ্য মতে, সাভারে শহীদ হওয়া নবী নুর মোড়ল এর স্ত্রী আকলিমা বেগম বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ১২৫ জনে নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও তিন শ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় এজাহারনামীয় আসামিদের সম্পর্কে নানাভাবে তদন্ত করা হয়। তদন্ত সাপেক্ষে এজাহারনামীয় ১২৫ আসামির মধ্যে ১১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করা হয়। এই মামলায় ১৮ জন এজাহারনামীয় আসামীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এমনকি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ না থাকায় এই মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি প্রদান করা হয়।

এই মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, আওয়ামী লীগের সাবেক সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব, আওয়ামী লীগের সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র হাজী আব্দুল গণি, সাবেক আওয়ামী ইউপি চেয়ারম্যান ফখরুল আলম সমর, আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক হাসান তুহিন, আওয়ামী লীগের সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেনসহ ১১৪ জন।

আশুলিয়া থানা সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত মামুন খন্দকারের স্ত্রী মোসাম্মৎ সাথী গত বছরের ২২ আগস্ট আশুলিয়া থানায় ৩৩ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলার তদন্তে আরও ১৯ জন আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাদের সহ মোট ৪৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এছাড়া এই মামলার এজাহার বহির্ভূত ১ জন ও এজাহারনামীয় ৭ জনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

চার্জশিটভুক্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম, ইয়ারপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহম্মেদ সুমন ভূঁইয়া, আশুলিয়া থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কবির সরকার, আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এনামুল হক মুন্সী, সাভার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান (সাবেক) ও মহিলা লীগ নেত্রী মনিকা হাসান, ধামসোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান মতি, মো. ছবেদ আলী, আশুলিয়া থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মইনুল ইসলাম ভূঁইয়া, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মারুফ হোসেন সরদার, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহিদুল ইসলাম, আশুলিয়া থানার সাবেক ওসি এএফএম সায়েদ, সাবেক তদন্ত ওসি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, ওসি অপারেশন নির্মল কুমার দাশ, ঢাকা জেলা উত্তরের সাবেক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (অ্যাডমিন) হোসেন শহীদ চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের ৪৫ নেতাকর্মী।

চার্জশিট দাখিল করা আশুলিয়া থানার অপর মামলা গত বছরের ২৮ আগস্ট দায়ের করেন শহীদ রমজান আলীর বাবা নজরুল ইসলাম। এই মামলায় ৬০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলায় এজাহারনামীয় ৪৯ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়। আর ১৭ জনের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য প্রমাণ ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকায় তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এ মামলাটিতেও সাবেক এমপি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে ফারুক হাসান তুহিন, সাবেক চেয়ারম্যান মো. পারভেজ দেওয়ান, সুমন ভূঁইয়া, কবির সরকার, ধামসোনা ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল সিকদার ধামসোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনসুর মিয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের ঢাকা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জালাল সাবেক ইউপি সদস্য সাদেক ভুঁইয়া সহ ৪৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শাহীনুর কবির বলেন, সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো খুব সূক্ষ্ম তদন্ত চলমান রয়েছে। যার মধ্যে তিনটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বাকি মামলা গুলোর তদন্ত প্রতিবেদন পর্যায়ক্রমে আদালতে দাখিল করা হবে।

সাভারের সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান একাধিক হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এখানে মধ্যম সারির দুই একজন নেতা বাদে সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব, তার ভাই ফকরুর আলম সমর, সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গোপনে দেশ ত্যাগ করে আস্তানা গেড়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।

সেখান থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এ ছাড়াও গণহত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে পুলিশের মধ্যে ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ঢাকার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান, সাভার মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহ জামান, আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এএফএম সায়েদসহ পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে।

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, আন্দোলনের ৮১ টি মামলার কয়েক হাজার আসামির মধ্যে আজ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ১শ জনকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

জুলাই বিপ্লবে সাভারে সংগঠিত গণহত্যার ঘটনায় সাভার আশুলিয়া ও ধামরাই থানায় ৭১ জন শহীদের তালিকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা আরও ৭৯টি মামলার যাচাই বাছাই কাজ চলছে।