একটা ঐতিহাসিক বৈঠক হয়ে গেল দূর শহর লন্ডনে। বৈঠকটি ইতিহাসের পাতায় একটা বিশেষ অধ্যায় হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। এ বৈঠক হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে। বলা বাহুল্য, দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে ততটা সুস্থ নন, যতোটা সুস্থ থাকলে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা যায়। ঐতিহাসিক বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে। চারদিকে হতাশা, একটা গুমোট ভাব। নির্বাচন কবে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই বা কবে ফিরবে, নিশ্চিত করে বলতে পারছিলেন না কেউ। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিলো, আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। ওদিকে তারেক রহমান বলছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া দরকার। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিলো, নির্বাচনের সময় নিয়ে এই মতপার্থক্য হয়তো বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি করবে সমাজে। কিন্তু না, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এমন বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন যে, জাতি সানন্দে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। লন্ডনে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে দুই নেতা প্রশংসনীয় স্টেটসম্যানশিপের পরিচয় দিলেন। বৈঠকে দুই নেতা একমত হয়েছেন-নির্বাচন আগামী রোজার আগেই, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই হতে পারে। সরকার ও বিএনপি, দুপক্ষই যার যার জায়গা থেকে সরে এসে একটা অভিন্ন জায়গায় পৌঁছেছেন। এটাই গণতন্ত্রের রীতি, এভাবেই গণতন্ত্রে কোনো সংকট দেখা দিলে আলোচনার টেবিলে সমাধান বের করতে হয়। এই সমাধানের মধ্য দিয়ে দুই নেতা আগামী দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতিকে উৎসাহিত করেছেন। জনতার আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নির্বাচনের এই সময় রাজনৈতিক পরিম-লকে স্বাভাবিক করে তুলবে নিশ্চয়।
বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এটারও ফয়সালা হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুতই সংস্কার ও জুলাই সনদের কাজ শেষ করতে হবে। বলা বাহুল্য, এ দুটো বিষয়ও জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো সম্পন্ন করা হলে আগামীতে যারাই ক্ষমতায় বসবেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে তাদের সুবিধা হবে। স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ ৫৩ বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত থেকে গেছে। সেগুলোর মীমাংসা হওয়া একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান সংবিধানেও রয়েছে বিতর্কযোগ্য অনেক বিষয়। এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে ওঠা দরকার। এ ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার যে আত্মদান, তারও স্বীকৃতি থাকা উচিত। লন্ডনের বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার ও জুলাই সনদ প্রশ্নে যে ঐকমত্য হয়েছে, তা বাস্তবায়নে এখন দরকার সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক প্রচেষ্টা। আমরা আশা করব, মূল দুই পক্ষ ছাড়াও রাজনীতির অন্যান্য স্টেকহোল্ডার প্রক্রিয়াগুলোকে এগিয়ে নিতে আন্তরিক ভূমিকা রাখবে। এ কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না, স্বৈরাচারের দোসররা সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে রুদ্ধ করতে চাইবে। এ বিষয়ে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সমগ্র জাতিকে সতর্ক থাকতে হবে। দেশে একটা নির্বাচনি আবহ তৈরি হয়েছে। যথাসময়ে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে বলেও কথা রয়েছে। আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে যারা, তারা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আচার-আচরণের মাধ্যমে প্রস্তুতি নেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সব স্টেকহোল্ডারের। জাতির যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হোক।