জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি বিনম শ্রদ্ধা

সম্পাদকীয়

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনের একটি শোকাবহ দিন। ১৯৭১ সালের এইদিনেই বাংলাদেশের ইতিহাসে যোগ হয়েছিলো এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তগঙ্গা পেরিয়ে জাতি যখন উদয়ের পথে দাঁড়িয়ে, দেশ যখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে-ঠিক সেই সময়েই বাঙালির কৃতী সন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা। বধ্যভূমিতে বড় অসহায় অবস্থায় নিঃশেষে প্রাণ দেন দেশের সেরা শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই হত্যাযজ্ঞের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিলো স্বাধীনতা লাভ করতে যাওয়া বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে ফেলা। রণক্ষেত্রে বীর বাঙালির হাতে নাস্তানাবুদ শেষে জাতিকে মেধাশূন্য করার এক সুদূরপ্রসারী ঘৃণ্য নীলনকশা বাস্তবায়নে নেমেছিলো তারা। ঘাতকরা চেয়েছিলো জাতির মেরুদ- ভেঙে দিতে। শ্বাপদীয় জন্তুর মতো ঘাতকরা ১৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকান্ড ইতিহাসে এক জঘন্যতম হত্যাকা-।

দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে এই দিনে ডা. ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সিরাজুল হক, চিকিৎসক গোলাম মুর্তোজা, আজহারুল হক, হুমায়ূন কবীর, মনসুর আলীসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হল, রায়েরবাজার নদীর তীর ও মিরপুরের কয়েকটি স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয় এসব বুদ্ধিজীবীকে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে এবং যুদ্ধ চলাকালে হত্যা করা হয় জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরও অনেক বুদ্ধিজীবীকে। মুনীর চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ ও শহীদুল্লা কায়সারও একইভাবে হত্যার শিকার হন। আর এই নারকীয় হত্যাকা-ের সর্বপ্রথম শিকার হয়েছিলেন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা।

আমরা বলতে চাই, যে জঘন্য ও নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছিলো, অনেক দেরিতে হলেও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারহীনতার দায় থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশ। সব রক্তচক্ষু ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের পরও সাহসিকতার সঙ্গে জাতিকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ঘাতকদের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যু। উল্লেখ্য, বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্যাতন করেছিলো পৈশাচিকভাবে। বুদ্ধিজীবীদের লাশে আঘাতের চিহ্ন ছিলো, কারও চোখ-হাত-পা বঁাঁধা, আবার কারও শরীর ছিলো ক্ষতবিক্ষত। এমনও ঘটেছে যে, লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহকে শনাক্ত করতে পারেননি। অনেকের আবার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমরা বলতে চাই, ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবী প্রাণ দিয়েছেন, তারা ছিলেন প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক। দেশকে, দেশের মানুষকে তারা ভালোবাসতেন। দেশে সত্য ও ন্যায়কেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। অথচ ঘৃণ্য বর্বরতার শিকার হয়ে তাদের জীবন দিতে হয়েছিলো। কিন্তু এটা ভুলে যাওয়া যাবে না, বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ বৃথা যাওয়ার নয়। দেশপ্রেম বিফলে যায় না।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর একটি ঘটনা। এই ঘটনার ভয়াবহতা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। যা আমাদের জন্য মহত্তম অর্জন। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই বিষাদে পরিণত হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের কারণে। বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের প্রিয় স্বাধীন এই মাতৃভূমি।

সর্বোপরি বলতে চাই, হত্যাকা-ের শিকার হওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবীরা তাদের মেধা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু ঘাতকদের ঘৃণ্য বর্বরতায় সেটি পারেননি। এটা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা মনে করি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারবো। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জানাই আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

Comments (0)
Add Comment