বিচার না হলে অপরাধ কমবে কীভাবে

সম্পাদকীয়

সমাজে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে ২০০০ সালে যে আইন করা হয়েছিলো, তার কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন ছিলো না। এই আইনের আওতায় আছে ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন ও হত্যা, অপহরণ, যৌন নিপীড়ন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, দাহ্য পদার্থ দিয়ে ক্ষতি করা, ভিক্ষাবৃত্তির উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানির মতো অপরাধ। এ আইনের মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সে জন্য বেশ কিছু বিধিও জারি করা হয়েছিলো। কিন্তু আইন পাসের ২২ বছর পরও ভুক্তভোগীর প্রতিকার না পাওয়া এবং নারী নির্যাতন না কমার ঘটনা উদ্বেগজনকই বটে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী প্রতি বছরই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বেড়েছে। এর মধ্যে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের দুই বছর ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছরের ১০ মাসে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ। পাঁচ বছর আগের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এখন মাসে গড়ে ৩৫০টি মামলা বেড়েছে। বিদ্বেষমূলক মন্তব্য, প্রতারণা, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। চলতি বছরের শুরুর দিকের তুলনায় শেষের দিকে অনলাইনে নির্যাতনের অভিযোগ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সামাজিক প্রেক্ষাপট তৈরির বড় কাজটি করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। অথচ বর্তমানে এই খাতে বরাদ্দ গত ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আশক) তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের ৬৪ শতাংশই ধর্ষণের খবর। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডব্লিউ) ভাষ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভুয়া আইডি, আইডি হ্যাকড, ব্ল্যাকমেলিং, মুঠোফোনে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন ৮ হাজার ৭১৫ নারী। যেসব কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার জটে লেগে আছে, সেগুলো হলো ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ না হওয়া, তদন্তে দুর্বলতা ও সময়ক্ষেপণ এবং মামলার তদন্তের সময় মেডিকেল সনদ ও ডিএনএ প্রতিবেদন (ধর্ষণের মামলায় আবশ্যক) পেতে দেরি হওয়া। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর চিকিৎসক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মামলার বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য পেতেও অযথা বিলম্ব হয়। উচ্চ আদালতের তথ্য অনুসারে, এ বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এক লাখ ৭৮ হাজার ২৩১। সবচেয়ে বেশি ১৮ হাজার ২৫টি মামলার বিচার চলছে ঢাকার ৯টি ট্রাইব্যুনালে। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন ও সালিস কেন্দ্র ১১ দফা পরামর্শ দিয়েছে, যার মধ্যে আছে সাক্ষীর নিরাপত্তা, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার স্থাপন। এসব কাজে সরকারের বরাদ্দ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি মামলার কোনো পর্যায়ে যাতে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে না যায়, সে বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। অপরাধ করে অপরাধী পার পেয়ে গেলে নারী ও শিশু নির্যাতন কমবে কীভাবে?

Comments (0)
Add Comment