শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যোগ্য শিক্ষক দরকার। আর যোগ্য শিক্ষকদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা দেয়া জরুরি। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ কথা মুখে স্বীকার করলেও বাস্তবায়ন করতে আগ্রহী দেখান না। এ ক্ষেত্রে নির্বাচিত কিংবা অনিরবাাচিত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে খুব ফারাক নেই। সবাই যেন ‘যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক’ নীতিতে বিশ্বাসী। এই প্রেক্ষাপটে গত শুক্রবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমাবেশকে আমরা কীভাবে দেখব? তারা চার দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন, যার মধ্যে আছে সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ, ২০১৪ সালের ৯ মার্চ থেকে সব প্রধান শিক্ষকের দশম গ্রেডে পদোন্নতির সরকারি আদেশ (জিও) জারি, চলতি দায়িত্বে থাকা সিনিয়র শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতি নিশ্চিত করা এবং চাকরির ১০ বছর ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রদান। এই দাবিগুলোর কোনোটাই অযৌক্তিক নয়। দাবি আদায়ে মাঠে আন্দোলনের পাশাপাশি শিক্ষকেরা আইনি লড়াই চালিয়েছেন। পক্ষে রায় পেয়েছেন। তারপরও সমস্যার সমাধান না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের আগেই কেন দশম গ্রেডে বেতন দেয়া হলো না? যেসব শিক্ষক মামলা করেছেন, শুধু তারা কেন এই সুযোগ পাবেন, অন্যরা বঞ্চিত থাকবেন, এটা যুক্তির কথা নয়। শিক্ষকেরা বলেছেন, দাবি আদায় না হলে তারা আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে লাগাতার অনশন কর্মসূচি পালন করবেন। যে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোনিবেশ করার কথা, তাঁদের কেন বারবার দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে? শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা হলেও এর প্রতি পূর্বাপর সরকারের অমার্জনীয় অবহেলা লক্ষ করা গেছে। সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক ও বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। বর্তমানে দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা আছে এবং সরকারি প্রাথমিকের বাইরেই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আছে। আগে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তথা কিন্ডারগার্টেন শহরাঞ্চলে সীমিত ছিলো, এখন গ্রামেও এ ধরনের হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার অবকাঠামোর বিষয়ে যতটা মনোযোগী, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসতে ততই অনাগ্রহী। একজন শিক্ষক যে বেতন-ভাতা পান, তা দিয়ে যদি পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে না পারেন, তার কাছ থেকে আমরা মানসম্পন্ন শিক্ষা আশা করবো কীভাবে? উন্নত দেশের শিক্ষকের সমান বেতন-ভাতা দূরে থাক, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকেরা অনেক কম বেতন–ভাতা পেয়ে থাকেন। যদি দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষকদের এভাবে বছরের পর বছর আন্দোলন করতে হয়, সেটা জাতির জন্য মর্যাদাকর নয়। অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাবিদ মনজুর আহমদের নেতৃত্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে যে কমিটি গঠন করেছিলো, তাদের সুপারিশও অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। শিক্ষকেরা সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। আশা করি, তার আগেই সরকার তাদের দাবিদাওয়া মেনে নেবে। সেই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে শিক্ষকদের বেতন–ভাতা বাড়ালেই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন নিশ্চিত হবে না। যথাসময়ে পাঠ্যবইসহ শিক্ষার সব উপকরণও শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দেয়া নিয়ে প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির শিকার হয়, তারও অবসান হওয়া জরুরি।