দামুড়হুদায় ভৈরব নদের প্রবাহ আটকে ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণে ধীরগতি পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ : বাঁধ উপচে ডুবছে ফসল

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় ভৈরব নদের পানি ধারণক্ষমতা, প্রবাহ ও নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শুকনা মরসুমে সেচ সুবিধা নিশ্চিতের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় দামুড়হুদা উপজেলার সুবলপুর গ্রামে নদের মাঝে ১৪ ভেন্টবিশিষ্ট পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো (ওয়াটার রিজার্ভার) নির্মাণ করা হচ্ছে। ভৈরব নদ পুনঃখনন (দ্বিতীয় পর্যায়) নামের এ প্রকল্পের কাজ শুরু ২০২২ সালে। শুরুতেই বাঁধ দিয়ে নদের পানিপ্রবাহ আটকে দেয়া হয়। ২০২৩ সালে নির্মাণ কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিলো। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, ভৈরব নদে দেয়া বাঁধের কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ফসলি জমিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। পাশাপাশি বাঁধ উপচে পড়া পানিতেও তাদের ফসল ডুবে যাচ্ছে। উপজেলার সুবলপুর, পাটাচোরা, কাঞ্চনতলা, রঘুনাথপুর, ছুটিপুর ও কাজলার চর এলাকার ফসলি জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফসল রক্ষায় কয়েকটি গ্রামের কৃষক সুবলপুরে ভৈরব নদের বাঁধ কেটে দিয়ে দিয়েছে। ফলে জমি থেকে কিছুটা পানি সরে গেছে। নির্মাণাধীন অংশ ডুবে যাওয়ায় ওই কাজ আপতত বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ শেষ হবে, তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি চুয়াডাঙ্গা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ আহমেদ বলেন, ‘পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণকাজ ৮৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। ওই পরিমাণ কাজে ব্যয় হয়েছে ২২ কোটি ২৮ লাখ টাকার কিছু বেশি। কাজটি পুরোপুরি শেষ হলে সুবিধা-অসুবিধা বোঝা যাবে।’ পাউবোর তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রকল্পটির কাজ উদ্বোধন করেন সাবেক সংসদ সদস্য আলী আজগার টগর। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছর শুরু হওয়া কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২-২৩ অর্থবছরে। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত মূল্য ধরা হয়েছিলো ৩১ কোটি ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২৬২ দশমিক ৪৬৫ টাকা। চুক্তি মূল্য ধরা হয়েছে ২৮ কোটি ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩৬ দশমিক ২১৯ টাকা। ২০২২ সালের ২১ জুলাই কার্যাদেশ দেয়া হলেও কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের ২৭ জুলাই। কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড ও কুষ্টিয়ার ঠিকাদার নাসির উদ্দিন মোল্লা যৌথভাবে কাজটি করছেন। গ্রামটির বাসিন্দা মোফাজ্জেল জানান, তার বাড়ি ভৈরব নদের পাড়ে। নদের মাঝে ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করে দেয়া হয়। দুই পাড়ের মাটি না থাকলে তার ঘরবাড়ি ভাঙনের কবলে পড়বে। এত বড় একটি প্রকল্পে দুই-পাঁচজন শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। গত চার বছর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খেয়াল খুশিমতো কাজ করে যাচ্ছে।’ একই গ্রামের মসলেম বলেন, ‘নদে বাঁধ দেয়ার কারণে ধান ও পাট ডুবে যাচ্ছে। ফসল বাঁচাতে চাষীরা বাঁধ কেটে দিয়েছে। কাজের ধীরগতির কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।’ চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (উদ্যান) দেবাশীষ কুমার দাস জানান, ভৈরব নদে বাঁধ দেয়ার কারণে ভেদামারী, কৈমারী ও কাজলা বিলের পানির উপচে ১২ হেক্টর আমন, ১৩ হেক্টর মরিচ, ১২ হেক্টর সবজি ও ১৫ হেক্টর জমির পেঁপে গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের এ ক্ষতি কাটাতে উদ্যোগ নেয়া হবে। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সী বলেন, ‘ছয়-সাতটি নদ-নদীর উৎসমুখ হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা। এখান থেকে নদ-নদীগুলো খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে। এমন একটি নদ ভৈরব। কিছুদিন আগে নদটি সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে নদ থেকে যতোটা সুযোগ-সুবিধা এলাকার মানুষের পাওয়ার কথা, তা পাওয়া সম্ভব হয়নি। পানিপ্রবাহ আটকে সুবলপুর পয়েন্টে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে, যাদের এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। নদী শাসনের কোনো যন্ত্রাংশ তাদের নেই। নদের প্রবাহ আটকে যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে, তা কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি হবে। দীর্ঘদিন বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ ঠেকিয়ে রাখার ফলে নদের তলদেশে পলি জমে নাব্যতা হারাবে। ফলে নদের পানি ধারণক্ষমতা কমে যাবে। যে অর্থ ব্যয় করে নদটি খনন করা হয়েছে সে অর্থ পানিতেই চলে যাবে।’ এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা পাউবোর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘দামুড়হুদা উপজেলার সুবলপুর গ্রামে ভৈরব নদের ভেতর ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ ভেন্ট বিশিষ্ট ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে কাজটি ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।’ ভৈরব নদে বাঁধ দেয়ার কারণে ফসল নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেদিকে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে।’ নদের দুই ধারে মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’ নদের পানিপ্রবাহ ঠেকাতে বাঁধ দিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা আইনসম্মত কিনা এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এভাবেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি করে আসছে।’