প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কৃষকের মেলবন্ধন: আইফার্মারের ফলনের আড্ডা

‘ধান রোপনের ২৫ দিন হয়েছে। জমিতে লেদা ও পাতা মোড়ানো পোকা দেখা দিয়েছে-এখন কী করা যায়?’-এভাবেই নিজের জমির ফসলের সমস্যার কথা বলছিলেন গোপালগঞ্জের কৃষক কামাল হোসেন।

সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, প্রশ্ন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকেরা একের পর এক পরামর্শ দিতে থাকেন। একজন জানান ‘এমিস্টার টপ’ নামের একটি কার্যকর ছত্রাকনাশকের কথা। আরেকজন বলেন, কিভাবে ‘সিনারিল ৮৫ ডব্লিউপি’ ২০ লিটারের পানিতে মিশিয়ে বিকেল বেলা স্প্রে করতে হবে। এই আলোচনায় আগ্রহ দেখান আরও কয়েকজন কৃষক। শেষ পর্যন্ত সমাধানটি কাজে লাগে কামালসহ সবারই।

এভাবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের এক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করেছে একটি মোবাইল অ্যাপ—ফলন। এই অ্যাপের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ফিচারটির নাম—‘আড্ডা’। এটি অনেকটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকের মতো, তবে শুধুই কৃষকদের জন্য—যেখানে দেশের নানা প্রান্তের কৃষকেরা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। কেউ ছবি পোস্ট করছেন, কেউ সমস্যার কথা বলছেন, কেউ পরামর্শ নিচ্ছেন কিংবা দিচ্ছেন। কখনো কখনো আবার নিজেদের সাফল্যের গল্পও ভাগ করে নিচ্ছেন।

৪৮ বছর বয়সি নারী কৃষক নড়াইলের তুলারামপুরের মোছা. রিনা খাতুন পড়ালেখা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পেশায় গৃহিণী হলেও দুই বিঘা জমিতে ধান, পাট, সরিষা চাষ করেন। বাড়ির উঠানে লাউ, কুমড়া, ধুন্দল—আর পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিও পালন করেন। আগে কৃষি বিষয়ে নানা সমস্যায় দোকানদারের পরামর্শের ওপর নির্ভর করতে হতো। তিনি বলেন, একই রোগ বারবার আসে, কিন্তু দোকানে যেটা দেয় তা অনেক সময় কাজ করে না। দোকানদার পরিচিত, তাই বারবার তার কাছেই যাই। তবে মাঝে মাঝে সঠিক পরামর্শের অভাবে ফসলের ক্ষতি হয়।

তবে একদিন এলাকার আইফার্মার প্রতিনিধির মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন ফলন অ্যাপ সম্পর্কে। তার মোবাইলে অ্যাপটি ডাউনলোড করে দেওয়া হয়। শুরুতে তিনি বেশ কয়েকবার ব্যবহার করে কৃষি বিষয়ক ভিডিও ও নির্দেশনা দেখেন, যা তার কাছে বেশ সহায়ক মনে হয়।

রিনা খাতুন বলেন, আমার মোবাইলে ফেসবুক, ইউটিউব, ইমো—এসব চালাই। কিন্তু কৃষি অ্যাপের ব্যবহার একটু আলাদা। কৃষি বিষয়ে নতুন ভিডিও আসলে দেখতে ভালো লাগে। তবে তিনি মনে করেন ভিডিওর সংখ্যা বাড়লে সেটি কৃষকদের জন্য আরো উপকার হতে পারে এবং অ্যাপসটি ব্যবহার করার জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণমূলক সহায়তা দেওয়া উচিত।

এরকমই আরেকজন কৃষক বগুড়ার রাইজুল ইসলাম। গত বছর তার মরিচখেতে ক্যাংকার বা ঘা রোগ দেখা দিয়েছিল। সেবার ভুল ওষুধ প্রয়োগের কারণে পুরো ফসলটাই নষ্ট হয়েছিল। এবারও এক সকালে সেই একই রোগের লক্ষণ চোখে পড়তেই, আর সময় নষ্ট করেননি রাইজুল। পকেট থেকে ফোন বের করে ফলন অ্যাপে ঢুকেছেন। অডিও নির্দেশিকা শুনে এবং বাংলায় লেখা প্রতিকার পড়ে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কী করতে হবে।

২০২৪ সালের নভেম্বরে চালু হওয়া ফলন অ্যাপ এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের কাছে এক নির্ভরযোগ্য সহায়ক হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে—যাকে সহজেই হাতের মুঠোয় রাখা যায়। কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ আইফার্মার অ্যাপটির উদ্ভাবক। প্রতিষ্ঠানটির এক মুখপাত্র বলেন, আমরা শুধু তথ্য দিতে চাইনি, আমরা চেয়েছিলাম কৃষকেরা নিজেরাই একটা কমিউনিটি হয়ে উঠুক—যেখানে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়াবে।

অ্যাপে ঢুকে একজন কৃষক জানতে পারেন—কোন ফসলের কী ধরনের রোগ হতে পারে, রোগবালাই থেকে প্রতিকারের উপায়, কোন সার কখন প্রযোজ্য। এসব নিয়ে আছে টেক্সট, ছবি, ভিডিও এবং অডিও ভিত্তিক নির্দেশনা। এছাড়াও আছে সরাসরি কৃষিবিদের সাথে কথা বলার মত সুবিধাও। শুধু রোগ ও চিকিৎসা নয়—ফলন অ্যাপ থেকে কৃষকেরা আবহাওয়ার আপডেট পাওয়ার পাশাপাশি জানতে পারেন কীভাবে গবাদিপশু, পোলট্রি, ফলমূল কিংবা মাছ চাষ করবেন। এছাড়াও ফসল ও গবাদিপশুর জন্য আর্থিক সহায়তার আবেদনও করতে পারছেন সহজেই।

একসময় কৃষিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কৃষকদের নির্ভর করতে হতো সীমিত উৎসের পরামর্শের ওপর, যা অনেক সময় পর্যাপ্ত হতো না। এখন সেখানে কৃষকেরা প্রশ্ন করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন-নিচ্ছেন, আবার অডিও নির্দেশিকা ও বাংলা প্রতিকার দেখে কিংবা কৃষিবিদের সহায়তায় সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের সাথে একই প্ল্যাটফর্মে এই অভিজ্ঞতা বিনিময়েই গড়ে উঠছে নতুন এক অনলাইন কৃষি-সমাজ। শিক্ষক, সহকর্মী, আর পরামর্শদাতা—সব ভূমিকাতেই আজ কৃষক নিজেই। আর এই সমন্বয় ঘটাতে সফল হয়েছে আইফার্মারের অ্যাপ—ফলন।