ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব : চরমপন্থার উত্থানে কি চরম ভাবাপন্ন জলবায়ুও দায়ী?

রহমান মুকুল : নদী শুকিয়ে গেলে সমাজও কি শুকিয়ে যায়? বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, আজ এক গভীর জলবায়ু সংকটে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় হার্ডিং ব্রিজ পয়েন্টে ১০-২০ হাজার কিউসেক পানি হ্রাস পেয়েছে, যা নদীর শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ফারাক্কার মরণ ছোবলে কাতরাচ্ছে পদ্মার দুকুলবাসী। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারতের একতরফা পানি ডাকাতির ফলে চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে মরুর হাহাকার! এ যেন মানবিক সভ্যতার বিরুদ্ধে দানবীয় চক্রান্ত। স্বাধীনচেতা বাংলাদেশীদের পানিতে-ভাতে মারার চক্রান্ত। পদ্মা ও তার সকল শাখা নদনদীর দুকুলের মানবসভ্যতার বুকে কারবালার মাতম! তেরশ নদীর দেশ এখন প্রবলভাবে মরুর ঝুকিতে। জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। নদীমাতৃক দেশের জলজ আবহাওয়ার চিরচেনা মানুষের স্বভাব প্রকৃতি কয়েক দশক আগেও যেমন ছিল, আজ তা নেই। প্রাকৃতিক পরিবর্তন, জবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের স্বভাবে উগ্রতা এসেছে। অল্পে রেগে যাওয়া, টেনশন, খুন খারাবি নিত্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আরব দার্শনিক ইবনে খালদুন প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের যে অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে, তা উল্লেখ করেছেন আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থে। নবাব আলীবদ্দী খাঁর সাথে নাটোরের রাজ পরিবারের সুসম্পর্ক সুবিদিত। সে সুসম্পর্কের কারণে নাটরের রাজা বৃহৎ রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক ছিলেন। রাণী ভবানী নবাব সিরাজুদ্দৌলার সাথে ভাই সম্পর্ক গড়ে ছুলেছিলেন। একবার রাণী ভবানীর নিমন্ত্রণ রাখতে নবাব সিরাজুদ্দৌলা নাটরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশি সময় অবস্থান করেননি। জোয়ার ভাটার এলাকা তাই নবাব সেখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করতে ভরসা পাননি। সকালে জোয়ার হলে বিকেলে নদীগুলোতে ভাটা হয়। অর্থাৎ, ওই এলাকার মানুষের মতো সকাল বিকেল পরিবর্তন হয়। স্থিরতা নেই। সে কারণে নবাব সিরাজুদ্দৌলা রাণী ভবানীর শত অনুরোধ উপেক্ষা করে দ্রুত মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন। রাজ্যজয়ের ধারাবাহিকতায় আলেকজান্ডার ৩২৭ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ভারতের..রাজ্যে উপস্থিত হন। তিনি ভারতবর্ষের তৎকালীন সবচে’ বড় রাজ্য গঙ্গারিডাই (গাঙ্গরিড/গঙ্গঋদ্ধি) জয়ের পরিকল্পনা করেন। তিনি আসমুদ্রহিমাচল এই দেশটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। জানতে পারেন যে, রাজ্যটিতে সুবিশাল হস্তিবাহিনি আছে এবং তা অপ্রতিরোধ্য। অন্যদিকে, আলেকজান্ডারের সৈন্যরা যুদ্ধক্লান্ত। সে কারণে আপাতত গঙ্গারিডাই জয়ের স্বপ্ন পরিত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তারপরও একই স্থানে তিনি দীর্ঘ ১৯ মাস অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন যে, এ রাজ্যের মানুষের আকৃতি, চেহারা বর্ণের বিদঘুটে বৈচিত্র্য। তাছাড়া, আকাশ খুব দ্রুত রঙ পরিবর্তন করে। আকাশের দিকে অবাক তাকিয়ে তিনি সেনাপতিকে বলেছিলেন, ‘সত্যিই, কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’ তাহলে, কয়েক দশক ধরে এই জনপদে ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া সহিংসতা, উগ্রপন্থা, ও সামান্য কারণে ক্রমবর্ধমান খুনখারাপির সাথে চরম ভাবাপন্ন জলবায়ুর সদর্থক সম্পর্ক রয়েছে? আসুন দেখি বিশেষজ্ঞদের মতামত কী —
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চরম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণœতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি ব্লগ পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন উদ্বেগ ও বিষণœতা, বাড়ছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আরও জটিলতা সৃষ্টি করছে। (ডড়ৎষফ ইধহশ (২০২১). ‘ঈষরসধঃব ঈযধহমব ধহফ গবহঃধষ ঐবধষঃয রহ ঝড়ঁঃয অংরধ.)’ সামাজিক সহিংসতা ও জলবায়ুর সম্পর্ক নাকি আরও মারাত্মক। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সামাজিক সহিংসতা ও অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। দুর্বল স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহিংসতা ছড়াচ্ছে । এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীরা আরও বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, যা একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে জলবায়ু সংকট ও মানুষের মানসিক রূপান্তর সম্পর্কে জানা যাক — ড. সৈয়দ শাবাব ওয়াহিদ (জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়) ও তার সহকর্মীরা বাংলাদেশের ৪৩টি আবহাওয়া স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, চরম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। তাদের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চরম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা এবং অন্যান্য জলবায়ু-সম্পর্কিত ঘটনা বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর উদ্বেগজনক প্রভাব ফেলছে, বিষণœতা ও উদ্বেগের দিক থেকে।’ সূত্র: (ডধযরফ, ঝ. ঝ., বঃ ধষ. (২০২৩). “ঈষরসধঃব ঊীঃৎবসবং ধহফ গবহঃধষ ঐবধষঃয রহ ইধহমষধফবংয.” এবড়ৎমবঃড়হি টহরাবৎংরঃু) ড. ফারহানা সুলতানা (সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়) বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু ন্যায়বিচার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের বিষয়। নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে মানুষের জীবিকা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে।’
সূত্র:(ঝঁষঃধহধ, ঋ. (২০২২). ‘ঈষরসধঃব ঔঁংঃরপব ধহফ ডধঃবৎ ঝবপঁৎরঃু রহ ইধহমষধফবংয.’ ঝুৎধপঁংব টহরাবৎংরঃু; চঁনষরংযবফ রহ এবড়ভড়ৎঁস, ঠড়ষঁসব)) ড. মের্সি টেম্বন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর। ড. টেম্বন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশকে তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে যাতে উদীয়মান জলবায়ু-সংবেদনশীল রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যায়।’
সূত্র: (গবৎপু ঞবসনড়হ, ইষড়ম চড়ংঃ ড়হ ডড়ৎষফ ইধহশ (২০২২), ‘ইধহমষধফবংয: ঝঃৎবহমঃযবহরহম ঐবধষঃয ঝুংঃবসং ঃড় অফফৎবংং ঈষরসধঃব ড়িস’) ড. রাহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুঃখ ও উদ্বেগ প্রায়ই একটি অপ্রতিরোধ্য অসহায়ত্বের অনুভূতি থেকে আসে, যা সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত।’ সূত্র: (জধযসধহ, গ. গ. (২০২১). “ঈষরসধঃব-রহফঁপবফ চংুপযড়ষড়মরপধষ উরংঃৎবংং রহ জঁৎধষ ইধহমষধফবংয.” চৎবংবহঃবফ রহ উযধশধ টহরাবৎংরঃু জবংবধৎপয গড়হড়মৎধঢ়যং; অথবা অনুরূপ গবেষণা অংরধহ ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ চংুপযরধঃৎু-তে প্রকাশিত হয়েছে।) ড. এমদাদ হক (ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়) বাংলাদেশের বন্যা ও নদীভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে মানুষের মানসিক চাপ ও অভিযোজন কৌশল নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সামাজিক সহিংসতা বাড়ে।’ সূত্র:(ঐধয়ঁব, ঊ., ্ ইষধরৎ, উ. (২০১৮). “ঊহারৎড়হসবহঃধষ উরংঢ়ষধপবসবহঃ, গবহঃধষ ঐবধষঃয, ধহফ অফধঢ়ঃরাব ঝঃৎধঃবমরবং রহ ইধহমষধফবংয.” চঁনষরংযবফ রহ উরংধংঃবৎ চৎবাবহঃরড়হ ধহফ গধহধমবসবহঃ, ঊসবৎধষফ চঁনষরংযরহম.)
করণীয়: এই সংকট মোকাবেলায় কেবল কূটনৈতিক বা অবকাঠামোগত সমাধান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন: মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণ। জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো: নদী পুনরুদ্ধার, জলাধার সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ফারাক্কা চুক্তির পুনর্বিবেচনা ও ন্যায্য পানি বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা।