কুষ্টিয়া করোনা হাসপাতাল জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে

২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের ৩০০ করোনা রোগী চিকিৎসাধীন

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: মিনিটখানেক আগে করোনায় এক নারী মারা গেলেন। দজন আয়া ট্রলিতে করে বারান্দা দিয়ে ওই নারীর লাশ বের করছেন। আয়ারা বলছেন, ‘সরেন, সরেন একটু সাইড দেন, লাশ বের হবে।’ মেঝেতে শুয়ে থাকা এক রোগীর স্বজন একটু সরে বসলেন। বিপরীত দিক থেকে আরেকটি ট্রলি আসছে। সেটিতে শুয়ে আছেন এক প্রসূতি, করোনায় আক্রান্ত। করোনা ওয়ার্ডে নেয়া হচ্ছে তাকে। দুটি ট্রলি পাশাপাশি আটকে গেল। জীবন আর মৃত্যু যেন পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। কাফনে মোড়া পাশের ট্রলির দিকে তাকিয়ে মুখটা পাংশু হয়ে গেল প্রসূতির। বৃহস্পতিবার এই চিত্র দেখা গেল কুষ্টিয়া করোনা হাসপাতালে। কান্না, আহাজারি আর রোগীদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের বাতাস। বিপরীত চিত্রও আছে। রেহেনা খাতুন তার বাবা রহিদুল ইসলামকে নিয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। রেহেনার চোখেও পানি। তবে সেটা আনন্দের। কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ৩০০ করোনা রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে করোনার ১নম্বর ওয়ার্ডের সামনে বারান্দায় বিমর্ষ মুখে বসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব আবদুল হান্নান। পাশে তার স্ত্রী আরিফা খাতুন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। হান্নানের শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। কাছে যেতেই আরিফা খাতুনের আকুতি, ‘বাবা, একটা জায়গা খুঁজে দেও না। তুমার (তোমার) চাচা একটু শুবে (শোবে)।’ করোনা ওয়ার্ডের শয্যাগুলোয় একটাও ফাঁকা নেই। ফাঁকা নেই ওয়ার্ডের সামনের বারান্দাগুলোয়ও। এমনকি পা ফেলারও জায়গাটুকু বের করাও মুশকিল। আবদুল হান্নানের মতো অন্তত ১০০ রোগীর ঠাঁই হয়েছে বারান্দায়। প্রত্যেক রোগীর বিছানার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার। বেলা একটার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। বারান্দায় রোগীদের শরীরে বৃষ্টির ছাট এসে পড়তে লাগলো। স্বজনেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পানি থেকে রোগীদের রক্ষায়। ৭০ বছর বয়সী সাইফুদ্দীন বিশ্বাসের গায়ে পানি পড়ছে। ছেলে আরিফ হোসেন পানি ঠেকানোর জন্য কাঁথা টাঙিয়ে দিলেন বারান্দার গ্রিলে। কাঁথা ভিজে যায়। সাইফুদ্দীনের মেয়ে ফারহানা পারভীন বাবাকে আগলে রাখেন। যেন পানি না পড়ে। কিন্তু বারান্দাময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোগীদের বৃষ্টির পানিতে ভিজতেই হলো। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন। বৃষ্টি থামলেও পানি আর ধুলা মিলে কাদা হয়ে যায় বারান্দাগুলো।
এদিকে অক্সিজেনের অভাবে মেঝেতে বসেই ছটফট করছেন মিরপুর উপজেলার বুরাপাড়া থেকে আসা করোনায় আক্রান্ত রোগী শরিফুল ইসলাম। বুকে মাথায় হাত রেখে হাউমাউ করে কাঁদছেন তার স্ত্রী অঞ্জনা খাতুন। দ্রুত পালস অক্সিমিটার নিয়ে এগিয়ে এলেন এক স্বেচ্ছাসেবী। অক্সিজেনের মাত্রা তখন ৫৪। দ্রুত একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এলেন। কিন্তু সেটা নষ্ট। আরেকটি নিয়ে এলেন। এদিকে শরিফুলের ছটফটানি বাড়ছেই। সঙ্গে বাড়ছে তার স্ত্রীর কান্না।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, করোনা রোগীদের যাদের অক্সিজেনের মাত্রা ৬০ এর নিচে তাদের ১নম্বর ওয়ার্ডে রাখা হয়। সেখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট আছে। এই হাসপাতালে ১২৫ জন রোগীকে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সবকটি শয্যাতেই রোগী। আর তাই শরিফুলের মতো যেসব রোগীর ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে, তারা সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সুবিধা পাচ্ছেন না।
সম্প্রতি রোগীদের চাপের কারণে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ওষুধের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ ওষুধই রোগীর স্বজনদের বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। ওষুধ না থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার। তিনি বললেন, বগুড়া থেকে ওষুধ পাঠানো হচ্ছে। ওষুধ যেমন নেই, তেমনি ঘাটতি আছে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার। মাত্র ২১টি যন্ত্র রয়েছে, চাহিদার তুলনায় যা খুবই কম।
আরএমও জানালেন, বৃহস্পতিবার হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক নাসিমুল বারী ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও একটি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা দেন। সরকারিভাবে চারটি আইসিইউ শয্যা থাকলেও সেটা নামমাত্র। শুধু শয্যা আছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা) এই হাসপাতালে ১৭ জন করোনা রোগী মারা যান। এর মধ্যে ১০ জন করোনা পজিটিভ। বাকি ৭জন উপসর্গ নিয়ে মারা যান।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More