ছিচকে চোর থেকে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী

গাংনীর কাথুলী সীমান্তের চিহ্নিত মাদক কারবারি সাহারুল

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুরের কাথুলী সীমান্ত এলাকার কুখ্যাত মাদক কারবারি হিসেবে চিহ্নিত সাহারুল ওরফে আবেদ (৪১) এখন পুলিশের খাঁচায় বন্দি। ১৫০ গ্রাম হেরোইনসহ তাকে গ্রেফতার করেছে মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)। সেই সাথে গ্রেফতার করা হয়েছে তার দুই সহযোগী সাবদুল হোসেন (৪৬) ও চঞ্চল মিয়া (৩০) কে। এটি মাদকের বড় চালানের ক্ষুদ্র একটি অংশ বলে এলাকাবাসীর মন্তব্য। এক সময়কার ছিঁচকে চোর কিভাবে মাদক স¤্রাট হিসেবে পরিণত হলো তা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য। তবে পুলিশ বলছে, তার কাছ থেকে মাদক পাচার ও তার আশীর্বাদপুষ্টদের নাম বের করার সব রকমেরই চেষ্টা চলছে।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, দিনমজুরী আর ছিচকে চুরির সাথে সাহারুল প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচে আলীশান একটি বাড়ি নির্মাণ করছে। যে বাড়িতে লাগানো হচ্ছে তিন লাখ টাকার টাইলস। মূলত এই বাড়ি নির্মাণের পর থেকেই তার মাদক ব্যবসার বিষয়টি গ্রামের মানুষের আলোচনায় আসে। ডিবির হাতে গ্রেফতারের পর শীর্ষ হেরোইন ব্যবসার বিষয়টি স্পষ্ট হয় এলাকার মানুষের কাছে।

সরেজমিনে তদন্তকালে জানা গেছে, মেহেরপুর গাংনী উপজেলার ভারত সীমান্ত গাড়াবাড়িয়া ঘাটপাড়ার পঞ্চত আলীর ৭ ছেলে আর চার মেয়ের মধ্যে সাহারুল চতুর্থ। দরিদ্র পরিবারে অভাব অনটনের সাথে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠে। সাংসারিক ও পারিপার্শিক নানা চিন্তা ভাবনায় একসময় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে হেরোইন সেবনে আসক্ত হয় সাহারুল। নেশার টাকা যোগাতে শুরু করে ছোটখাটো চুরি। এলাকায় পরিচিতি পেয়ে যায় আবেদ চোর হিসেবে। সাহারুল নামের চেয়ে আবেদ চোর বলেই তার বেশি পরিচয় রয়েছে।

জানা গেছে, চুরির পাশাপাশি দিঘিরপাড়ার কথিত সোর্স ও তাস জুয়াড়ি বাদলের সহচার্যে এসে মাদক পাচারের কাজ শুরু করে। দিনমজুরি করে যা পাওয়া যায় তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলতো। কিন্তু মাদক পাচারে বেশি লাভ সেই সাথে নেশার কাজটিও পোক্ত। ফলে মাদক পাচারের কাজটি বেছে নেয় সাহারুল। গাংনীর কাজিপুর রংমহল ও সহড়াতলা বুড়িপোতাসহ একাধিক স্থান থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক এনে পৌঁছে দিত গন্তব্যে। এক সময় নিজেই মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটানো শুরু করে। আর এ কাজে নজরদারী করতো সাহারুলের স্ত্রী শিরিনা। বছর দশেক আগে শুরু হওয়া এ মাদক ব্যবসা প্রথমে একটু গোপনে চললেও পরে প্রকাশ্যে আসে। নিরিবিলি স্থানে বাড়ি হওয়ায় মাদক সেবনকারীরা নিরাপদ স্থান ভেবে তা সেবন করতে আসে। বিশেষ করে দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলতো মাদক আঁখড়া। কিশোর থেকে মধ্য বয়সিরা বিভিন্ন যানবাহনে করে এসে সেবন করে চলে যেতো নির্বিঘেœ। এর এ কাজে সহায়তা করতো তারই ঘনিষ্ট কয়েকজন আত্মীয়।

স্থানীয়রা জানান, সাহারুল গ্রেফতার হয়েছে কয়েকবার। জামিন পেয়ে বাড়ি আসার পরই শুরু হয় পুরাতন ব্যবসা। প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে রাত অবধি তার বাড়ির আশেপাশে মোটর সাইকেলের ভিড় লেগেই থাকতো। বাড়িতে এবং বাড়ির আশেপাশে ঘুরে ফিরে মাদক বিক্রি করাই ছিল সাহারুলের আসল কাজ। প্রাপ্ত তথ্যমতে, মাদকের বড় চালান এলে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাখা হতো। পরে ওখান থেকে নিয়ে খুচরা বিক্রি করা হতো। সরবরাহ করা হতো হেরোইন সেবনের ফোয়েল পেপারও। সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতো তার ঘনিষ্ট কয়েকজন। কোন অপরিচিত লোক দেখলেই দেয়া হতো লাল সংকেত। মাদকসেবীরাও অপরিচিতদেরকে নানা ধরনের জেরা করতো। স্থানীয় লোকজন ভয়ে মুখ খুলতো না। কেউ কোন প্রতিবাদ করলে তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হতো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার অনেকেই জানান, সাহারুল এমনই বেপরোয়া ছিল যে, প্রকাশ্য দিবালোকে গরু ছাগল খুলে বিক্রি করে নিতো। সন্ধ্যার পর সে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠতো। তার রোষাণলে পড়েনি এমন সাধারণ ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীর সংখ্যা কম। অনেকেই তার হাতে নিগৃহের স্বীকার হয়েছেন। একযুগ আগে গ্রামের জনৈক হারানকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করে সাহারুলসহ কয়েকজন। সাহারুলের বেপরোয়া চলাচল ও কর্মকা-ে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। অনেকেই ভাবতো পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই সে মাদক পাচার কাজ করতো। ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতো না। অবশেষে গ্রেফতার হওয়ায় পুলিশের প্রতি আস্তা ফিরে এসেছে অনেকেরই। সাহারুলের মা ছাবিরন খাতুন সত্যতা স্বীকার করে জানান, মাঠে ঘাটে কাজ করে সাহারুল। মাঝে মধ্যে নেশা করতো। ব্যবসা করার কথাও শুনেছেন তিনি। তবে এতো বড় ব্যবসা করে সেটি মানতে নারাজ। তিনি আরো জানান, মাঠের জমি বিক্রি করে বাড়ি করেছেন। একটি ছেলেকে মাদরাসাতে পড়াচ্ছেন। একই দাবি করেছেন সাহারুলের অন্যান্য ভাবীরাও।

এদিকে সাহারুলের মা ও ভাবীদের এমন দাবি মানতে নারাজ গ্রামের লোকজন। তারা জানান, একসময় যার বাড়িতে ভাত জুটতোনা। চুরি করে সংসার চালাতো। সে এখন বিত্ত বৈভবের মালিক। কাড়িকাড়ি টাকা লগ্নী করেছেন ব্যবসায়। গড়েছেন আলীশান বাড়ি। হঠাত করে এতো পরিবর্তন একমাত্র অসৎ উপায়ে অর্জিত ছাড়া সম্ভব নয়। স্থানীয়রা জানান, সাহারুল গ্রেফতার হয়ে যে কদিন হাজতে থাকে সে সময়টা গ্রামের মানুষ ভালো থাকে। জামিন পেয়ে বাড়ি আসার পরই আবার ব্যবসা শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মাদকসেবীদের দৌরাত্মে এলাকার মানুষ অতিষ্ট হলেও প্রতিবাদ করার উপায় নেই। সাহারুল হাজতে থাকায় এখন আর কেউ আসছে না। তার সাথে জড়িত অন্যান্য মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীরা আইনের আওতায় আসলে এলাকার মানুষ স্বস্তি পাবে। একই সাথে সাহারুলের দৃষ্টান্তমূলক সাজাও দাবি করেন তারা।

প্রসঙ্গত, গেল সোমবার দিনগত রাতে সদর উপজেলার কামদেবপুর গ্রামে মাদক পাচারের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হয় গাড়াবাড়ীয়া গ্রামের সাহারুল ইসলাম ওরফে আবেদ চোরসহ তার দুই সহযোগী। তাদের কাছ থেকে ১৫০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে ডিবি। যার আনুমানিক মূল্য ১৫ লাখ টাকা বলে জানায়। হেরোইন পাচারের অপরাধে সাহারুল ও তার দুই সহযোগী ডিবির দায়ের করা মামলায় আদালতের আদেশে মেহেরপুর জেলা কারাগারে হাজতবাসে রয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More