জীবননগরে পাটের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি

সালাউদ্দীন কাজল: জীবননগর উপজেলার মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি কম হওয়ায় পাট জাগ দিতে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিলো পাট চাষিদের। পরবর্তীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় সেই সমস্যা কেটে গেছে। ঠিকমতো পাট কেটে জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে শুকিয়ে সেই পাট এখন বাজারে বিক্রির ধুম পড়েছে। অনুকুল আবহাওয়ার কারণে এ বছর পাটের ফলনও যথেষ্ট ভাল হয়েছে। বর্তমানে সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বাজারে নতুন পাটের ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। এতে বেশ আনন্দিত চাষিরা। দীর্ঘ দিন পর হাসি ফিরেছে সোনালী আঁশে।
কৃষকরা এখন পাট নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কোথাও খাল-বিল, পুকুর কিংবা ডোবায় পাট কেটে জাগ দেয়ার জন্য ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। আবার হাইওয়ে কিংবা গ্রামীণ রাস্তার পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে সারি সারি করে শুকাতে দেয়া হয়েছে পাট। কোথাও বা আবাদকৃত পাটগাছ কেটে জাগ দিয়ে সেখান থেকে পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ আঁশ ছাড়ানো পাট শুকিয়ে ঘরে তুলছেন। গ্রামাঞ্চলে এখন একটাই দৃশ্য চোখে পড়ে সোনালি পাট নিয়ে ব্যস্ত কৃষক-কৃষাণীরা। অনেক জায়গায় সড়কের দুই পাশে নারী ও পুরুষকে পাট শুকানোর কাজ করতেও দেখা যায়। আবার অনেকে অটোরিক্সা, ভ্যান, আলমসাধুতে করে বাজারে পাট নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে নতুন পাটের গন্ধে এখন গ্রামগঞ্জ মাতোয়ারা।
গত কয়েক বছর ধরেই পাটের দাম ভাল যাচ্ছে। এর মধ্যে গত বছর (২০২০ সাল) পাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পাটকাটা মৌসুমের শুরুতেই প্রতিমণ পাট বিক্রি হয় ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা দরে। পরে এটি ৩৫শ’ এবং মৌসুমের শেষ পর্যায়ে হাটে প্রতিমণ পাটের দাম ৫ হাজার টাকা পৌঁছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর প্রতিমণ পাটের গড় মূল্য হয়েছিল ৩৫শ’ টাকা।
পাট চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাট চাষ করে তিন মাসের মধ্যে পাট ঘরে তোলা যায়। কম সময়ে, কম পরিশ্রমের ফসল পাট। প্রতি বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ১০-১২ মণ পাট উৎপাদন হয়। এবার বাজারে পাটের মান ভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮শ’ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। এত দামে বিক্রির কারণে পাট চাষের খরচ বাদ দিলে অভাবনীয় মুনাফা পাচ্ছেন পাটচাষিরা।
জীবননগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, জীবননগর উপজেলায় এবার ২ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। উপজেলার কৃষকরা এবার রবি-১ ও তোষা-৮ জাতের পাট চাষ করেছেন। প্রতি হেক্টর জমিতে পাট উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ দশমিক ৬ টন। এ হিসেবে উপজেলায় এবার ৭ হাজার ২৭২ টন পাট উৎপাদন হবে। বর্তমানে পাট কাটা ধোয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিভিন্ন হাট বাজারে পুরোদমে পাট বেঁচাকেনা চলছে। এ বছর পাটের রঙ ভাল হওয়ায় যে কোন বছরের তুলনায় দাম অনেক বেশি।
জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া, হাসাদাহ ও উথলী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাট নিয়ে এসেছেন বিক্রির জন্য। প্রতি মণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮শ’ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। পাটের দাম শুরুতেই ভাল থাকায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
জীবননগর উপজেলার নিধিকুন্ড গ্রামের পাটচাষি মিজানুর রহমান জানান, তিনি ২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। ২ বিঘা জমিতে প্রায় ২৪ মণ পাট হয়েছে। তিনি সেই পাট বাজারে নিয়ে প্রতিমণ ২ হাজার ৮শ’ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে তার অনেক লাভ হয়েছে। কম খরচে, কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় খুব খুশি তিনি।
মাধবপুর গ্রামের পাটচাষি আবুল কাশেম জানান, সোয়া ২ বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। ওই জমিতে ১৮ মণ পাট হয়েছে। প্রতিমণ ২ হাজার ৯শ’ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে তার খরচ বাদে ৩৭ হাজার ২শ’ টাকা লাভ হয়েছে। পাট বিক্রি করে খুব খুশি তিনি।
ধোপাখালী গ্রামের পাটচাষি মাধব বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ফলনও হয়েছে ভাল। শুরুতে দাম পাব না বলে ভেবেছিলাম। এখন বাজারে প্রায় দ্বিগুণ দামে পাট বিক্রি করছি। গত ৫-৭ বছরেও এত বেশি দামে পাট বিক্রি করতে পারিনি। এছাড়াও আরও অন্তত ২০ হাজার টাকার পাটকাঠি জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করতে পারব। এবছর পাটের দ্বিগুন দাম পেয়ে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।
উথলী গ্রামের কৃষক মোমিন হোসেন বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ২০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এছাড়া জ্বালানী হিসেবে পাট খড়ির ব্যপক চাহিদা রয়েছে।
উপজেলার একতারপুর গ্রামের এখন প্রতিমণ নতুন পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৮শ’ টাকা দরে। এই দামে পাট বিক্রি করে ওই গ্রামের কৃষক লিয়াকত সিকদার বেজায় খুশি। মুখের হাসিটা আরও চওড়া করে তিনি বলেন, এর আগে কখনোই এত দামে পাট বিক্রি করিনি।
সন্তোষপুর গ্রামের পাট ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান বলেন, করোনা মহামারীর মধ্যে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় পাটের বেশ ভাল দাম পাচ্ছেন কৃষক। বছরের কেনাবেচাও শুরু হয়েছে চড়া দামেই। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭শ’ টাকা থেকে ২ হাজার ৮ শ’ টাকায়। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এত দামে পাট বিক্রি হয়নি।
হাসাদাহ বাজারের পাটের আড়তদার লিয়াকত হোসেন বলেন, হাটে পাট আসতে শুরু হয়েছে। দাম গত বছরের তুলনায় বেশ ভাল। দাম এভাবে থাকলে কৃষকরা লাভবান হবেন।
জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, এবার পাটের ভাল ফলন হয়েছে। কৃষকরা বর্তমান পাটের বাজার দর অনুযায়ী উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে ভাল লাভ পাচ্ছেন। পাটের দাম এ রকম থাকলে আগামী বছর কৃষকরা আরও ব্যাপকভাবে পাট চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন। এবার পাটের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এত দাম দীর্ঘসময়ে ছিল না। গত দুই বছর থেকে পাটের দাম খুব ভাল যাচ্ছে। এতে কৃষকের পাট চাষে আগ্রহ বেড়েছে। ফলে উপজেলায় পাট আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে সর্বক্ষেত্রে পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করছে সরকার। এতে আমাদের পরিবেশ রক্ষা পাবে, পাশাপাশি সম্ভাবনাময় সোনালি পাটের হারানো গৌরব আবারও ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More