সোনা পাচারের নিরাপদ রুট জীবননগর সীমান্ত

দুয়েকজন আটক হলেও মূল হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে

সালাউদ্দীন কাজল: সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার গয়েশপুর, মেদেনীপুর, বেনীপুর ও হরিহরনগর সীমান্তসহ দর্শনা, দামুড়হুদা এবং মহেশপুর উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার অন্তত ২০টি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এ রুটগুলো দিয়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ কেজি স্বর্ণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করছে। এসব স্বর্ণ পাচারকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নির্বিঘেœ কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ প্রতিদিনই নানা কৌশল আর মাধ্যম অবলম্বন করে চোরাইপথে ভারতে পাচার করছে। প্রশাসনের অভিযানের কারণে প্রায়ই দু’একজন বহনকারী ধরা পড়লেও মূল হোতারা বরাবরই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এ সোনা চোরাচালান। এ চক্রের মূল হোতারা ধরা না পড়ায় স্বর্ণ পাচারের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। স্বর্ণ পাচারকারী সিন্ডিকেটে রয়েছে রাজনৈতিক দলের সদস্য, জনপ্রতিনিধি এবং সাংবাদিক।

বিজিবি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকেলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহেশপুর-৫৮ ব্যাটালিয়নের নিমতলা ক্যাম্পের সদস্যরা দর্শনা থেকে জীবননগর আসার পথে আকন্দবাড়ীয়া নামকস্থানে আব্দুস শুকুর (৩৫) নামে এক স্বর্ণ চোরাকারবারীকে ৫১ লাখ টাকা মূল্যের ৫৯ ভরি ওজনের ৬টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে। আটককৃত আব্দুস শুকুর বিজিবির কাছে জানান, ভারতে পাচারের জন্য স্বর্ণগুলো সীমান্তে নিয়ে যাচ্ছিলেন। একই দিন যাদবপুর বিওপির টহল দল মহেশপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের একটি কলাবাগানের মধ্যে থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৮ কোটি ৪ লাখ টাকা মূল্যের ৯৪৬ ভরি ওজনের ৮৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। এর আগে শনিবার দিনগত রাত ৩টায় ঢাকার কেরাণীগঞ্জের চুলকুটিয়ায় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সদস্যরা জীবননগরগামী পূর্বাশা পরিবহন ও রয়েল এক্সপ্রেস বাস দুটি তল্লাশী করে তিন ভারতীয় নাগরিকসহ ১২ জনকে আটক করে। পরে তাদের দখলে থাকা ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৬৩৭ ভরি স্বর্ণ জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দারা। আটককৃতরা জানান, সোনার বারগুলো ভারতে পাচার করার উদ্দেশ্যে জীবননগর সীমান্তে নেয়া হচ্ছিলো। আসামিরা এ কাজে সরাসরি জড়িত এবং সোনা চোরাকারবারী চক্রের সদস্য। তার আগে ২৫ সেপ্টেম্বর দামুড়হুদা উপজেলার নাস্তিপুর গ্রাম থেকে ৯ কেজি ৮৬০ গ্রাম ওজনের ৫৮টি স্বর্ণের বারসহ রকিবুল নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে বিজিবি। একই দিন রাতে চুয়াডাঙ্গা শহরের বিএডিসি মোড়ে পুলিশ অভিযান চালিয়ে জুয়েল ও আরিফ নামের দুই স্বর্ণ চোরাকারবারীসহ ৫০ ভরি ওজনের ৫টি স্বর্ণের বার আটক করে। ২৬ সেপ্টেম্বর জীবননগর উপজেলার চ্যাংখালী সড়কের মোল্লা ব্রিকসের সামনে থেকে গোয়ালপাড়া গ্রামের তাজুল ইসলামকে ৪টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে বিজিবি। ২৯ সেপ্টেম্বর মহেশপুর মাটিলা ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা অভিযান চালিয়ে শওকত আলী নামের এক ব্যক্তিকে ৪ কেজি ৬৬৫ গ্রাম ওজনের ৪০টি স্বর্ণের বারসহ আটক করে। এসব আটকের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। একাধিক সূত্র জানায়, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে নিয়ে আসা স্বর্ণের বার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লোকজন কমিশনের বিনিময়ে বিমানবন্দর পার করে দেয়। এরপর ১০ তোলা ওজনের প্রতিটি স্বর্ণের বারের জন্য দুই হাজার টাকা কমিশন নিয়ে জীবননগর উপজেলার স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যরা ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনযোগে জীবননগরে নিয়ে আসে। পরে সময়-সুযোগ বুঝে সোনা চোরাকারবারিরা স্বর্ণের বারগুলো সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেয়। অভিযোগ রয়েছে, ইতোমধ্যে এ অবৈধ ব্যবসা করে অনেকেই অল্প দিনেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, যাদের জমি-যায়গা নেই, কোনো ব্যবসা নেই অথচ তারা স্বর্ণ চোরাচালানী করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। প্রতিদিনই তাদের ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়।

অভিযোগ রয়েছে, স্বর্ণ চোরাচালান মামলার ঘটনায় যারাই গ্রেফতার হয়েছে তারা সবাই বহনকারী। মালিক কিংবা গডফাদাররা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্তকালে গ্রেফতারকৃতদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও রাঘব বোয়ালদের নাম-ঠিকানা আদায়ে ব্যর্থ হন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাষ্ট্রিয় গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, জেলায় স্বর্ণ চোরাকারবারীদের নামের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে স্বর্ণ চোরাকারবারী হিসেবে যাদের নাম পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাংক একাউন্টের লেনদেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল খালেক বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।

বিজিবির মহেশপুর-৫৮ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহিন আজাদ বলেন, মহেশপুর ও জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন সীমান্তের সব ধরনের চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালান বন্ধ করতে বিজিবি সদস্যরা তৎপর রয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More