আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া মহারণ আজ

কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইলানটি ছড়াচ্ছে উত্তেজনা

স্টাফ রিপোর্টার: কিছু পরাজয় ক্ষত রেখে যায় গভীরে, যা পোড়াতে থাকে সর্বক্ষণ। চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষের সেই হারটি ছিল আর্জেন্টিনার জন্য ঠিক তেমনি। আর ওই পরাজয়ের ধাক্কা সামলে অনেক কষ্টেসৃষ্টে গ্রম্নপ পর্ব লিওনেল মেসিরা পার হতে পেরেছিলেন বটে। কিন্তু গ্রম্নপ রানার্সআপ হওয়ার সুবাদে, সেবার শেষ ষোলোয় দেখা হয়েছিলো ফ্রান্সের সঙ্গে। সেখানেও বিষাদ সঙ্গী। শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনার। এবার সেই বকেয়া হিসাব সুদে-আসলে চুকানোর পালা দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের। যদিও চার বছর আগের আর্জেন্টিনা দলের সঙ্গে বর্তমান দলের পার্থক্য অনেক। তারপরও চলমান আসরে ল্যাটিন আমেরিকা দলের প্রাণভোমরাই হলেন লিওনেল মেসি। তার কাঁধে ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। নিজে গোল করছেন, করাচ্ছেন সতীর্থদের দিয়েও। উপহার দিচ্ছেন জাদুুকরী সব মুহূর্ত। বেশির ভাগ প্রতিপক্ষের লক্ষ্যই থাকে সময়ের সেরা এই ফরোয়ার্ডকে আটকে রাখার। তবে ক্রোয়েশিয়া কেবল মেসিকে নিয়ে পড়ে থাকতে নারাজ। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে আজ মঙ্গলবার দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হবে ক্রোয়েশিয়া। লুসাইল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় শুরু হবে এই ম্যাচটি। লুকা মদ্রিচ ও মেসিদের সরাসরি ম্যাচটি দেখা যাবে বিটিভি, গাজী টিভি ও টি স্পোর্টসে। বিশ্বকাপ ও সব মিলিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে নেই এই দুই দলের কেউ। ফাইনালে ওঠার মঞ্চ হবে সমতা ভাঙার লড়াইও। হাইভোল্টেজ ম্যাচটির আগে আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়ার আরও কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেয়া যাক। আর এই নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলছে ক্রোয়েশিয়া। ২০১৮ সালে শেষ চারে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে তারা, যা দলটির সর্বোচ্চ সাফল্য। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে ৪-২ গোলে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত চারবার টাইব্রেকারের পরীক্ষা দিয়ে শতভাগ সফল ক্রোয়েশিয়া। গত আসরে শেষ ষোলোয় ডেনমার্ক ও কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়াকে পেনাল্টি শুটআউটে হারায় তারা। এবার নকআউট পর্বের প্রথম ধাপে জাপানের বিপক্ষে ও শেষ আটে ব্রাজিলের বিপক্ষে টাইব্রেকারে জিতেছিলো দলটি। আর কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে সমতা টানা গোলটি করেন ব্রম্ননো পেতকোভিচ। ম্যাচটিতে ওই একটি শটই লক্ষ্যে রাখতে পেরেছিলো ক্রোয়েশিয়া, আর সেটাতেই পেয়ে যায় তারা জালের দেখা। ২০০২ সালে ব্রাজিলের পর প্রথম দল হিসেবে টানা দুইবার ফাইনালে খেলার সম্ভাবনা জাগিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বকাপে নিজেদের সবশেষ ১২ ম্যাচের ১১টিতে অপরাজিত ক্রোয়েশিয়া; একমাত্র হার ফ্রান্সের বিপক্ষে, ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে। আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসির সামনে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলার হাতছানি। ২০১৪ সালে জার্মানির বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে হৃদয় ভাঙে ল্যাটিন আমেরিকার দলটির। ক্লাব ও জাতীয় দলে সম্ভাব্য সব ট্রফি পেয়েছেন লিওনেল মেসি। কেবল বিশ্বকাপই এখনো জেতা হয়নি আর্জেন্টাইন এই মহাতারকার। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি ১০ গোলের রেকর্ডে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার সঙ্গী এখন লিওনেল মেসি। সিংহাসনে একা বসতে ¯্রফে এক গোল চাই মেসির। যদিও সৌদি আরবের বিপক্ষে হার দিয়ে এবারের বিশ্বকাপে পথচলা শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর চার ম্যাচে ¯্রফে তিন গোল হজম করে ষষ্ঠবারের মতো সেমিফাইনালে ওঠে তারা। এখন পর্যন্ত দুইবার শিরোপা জিতেছে আর্জেন্টিনা, ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে। তিনবার হয়েছে তারা রানার্সআপ। বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দুইবার মুখোমুখি হয়েছে আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া। যেখানে একটি করে জয় দুই দলেরই। ১৯৯৮ সালে গ্রম্নপ পর্বে ১-০ গোলে জিতেছিল ল্যাটিন আমেরিকার দল আর্জেন্টিনা। আর গত আসরে গ্রম্নপ পর্বেই তাদের ৩-০ গোলে হারিয়ে দেয় ক্রোয়েশিয়া। আর্জেন্টিনা ও ক্রোয়েশিয়া সব মিলিয়ে পরস্পরের বিপক্ষে খেলেছে পাঁচ ম্যাচ। যেখানে দুটি করে জয় আছে এই দল দুটির। অপর ম্যাচটি ড্র হয়েছে। চলতি বিশ্বকাপে দারুণ ছন্দে রয়েছেন ৩৫ বছর বয়সি মেসি। অনেকের চোখে আর্জেন্টিনা অধিনায়ককে দেখা যাচ্ছে তার সেরা চেহারায়। ভাবনার পেছনের কারণও আছে যথেষ্ট। এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচ খেলে ৪ গোল করেছেন মেসি, করিয়েছেন দুটি। তিন ম্যাচে জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। আর তাই মেসিকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য যেকোনো প্রতিপক্ষ। গত আসরের রানার্সআপ ক্রোয়াটদের পরিকল্পনায় স্বাভাবিকভাবেই আছেন তিনি। ক্রোয়েশিয়া দলটির ফরোয়ার্ড ব্রম্ননো পেতকোভিচের মতে, স্রেফ মেসিকে থামানোর জন্য মাঠে নামবেন না তারা। তাদের লক্ষ্য পুরো আর্জেন্টিনাকে ঠেকিয়ে দেয়া। ম্যাচের আগের দিন সোমবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, ‘মেসিকে থামানোর জন্য আমাদের এখনো নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। সাধারণত আমরা একজন খেলোয়াড়কে আটকানোর দিকে মনোযোগ দিই না বরং পুরো দলকে থামানোর চেষ্টা করি। দল হিসেবে আমরা তাদের থামানোর চেষ্টা করব, ম্যান-মার্কিং করে নয়। আর্জেন্টিনা দলে কেবল মেসিই নন, তাদের বেশ কয়েকজন দারুণ খেলোয়াড় আছে। আমাদের পুরো আর্জেন্টিনা দলকে থামাতে হবে।’ অপরদিকে রুদ্ধশ্বাস এক জয়ে নেদারল্যান্ডস চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা আর্জেন্টিনা পা রাখছে মাটিতেই। শেষ চারে তাদের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া, যারা ব্রাজিলকে হারিয়ে এসেছে এখানে। লম্বা সময় ধরে একই কোচের সঙ্গে কাজ করা ক্রোয়াটদের কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক মেসি, অনেক কঠিন ম্যাচ হবে। ক্রোয়েশিয়া দেখিয়েছে, তারা দারুণ একটি দল। ব্রাজিলের বিপক্ষে তারা সমানে সমানে খেলেছে। এমনকি মাঝেমধ্যে ব্রাজিলের চেয়ে ভালো ছিলো তারা। তাদের খেলতে দিলে, দলটিতে খুব ভালো খেলোয়াড় আছে। যারা বল খুব ভালোভাবে খেলে, বিশেষ করে মিডফিল্ডে।’ আর ক্রোয়েশিয়া একটু সুযোগ পেলে কী করতে পারে, না জানার কোনো কারণ নেই মেসির। গত আসরে গ্রম্নপ পর্বে ইউরোপের এই দলটির বিপক্ষে হেরেছিলো আর্জেন্টিনা। তাছাড়া ২০১৭ সাল থেকে ক্রোয়েশিয়ার কোচের দায়িত্বে আছেন জলাতকো দালিচ। তার কোচিংয়ে রাশিয়া আসরে ফাইনাল খেলেছিল দলটি। তাইতো প্রতিপক্ষের লক্ষ্য না বোঝার কথা নয় মেসির, ‘ক্রোয়েশিয়া এমন একটি দল, যারা গত বিশ্বকাপের আগে থেকেই একই কোচ দালিচের সঙ্গে কাজ করে আসছে। তারা একে অপরকে খুব ভালো করে চেনে, তারা একটি লক্ষ্যে এগোচ্ছে। আজ (মঙ্গলবার) প্রথম সেমিফাইনাল, যেটি খুব কঠিন হতে যাচ্ছে।’ এবারের আসরে গোল করছেন, করাচ্ছেন মেসি। কড়া পাহারার মধ্যেও জাদুকরী মুহূর্ত উপহার দিচ্ছেন। যেখান থেকে পাস দেয়া অসম্ভব মনে হচ্ছে, সেটাও দিচ্ছেন অবলীলায়। তবে এই মেসিকেও ভয় পাওয়ার কিছু দেখছেন না ক্রেয়েশিয়ার কোচ জলাতকো দালিচ, ‘মেসিকে পাহারায় রাখতে হবে, তবে পেস্নয়ার-অন-পেস্নয়ার স্টাইলে নয়, কারণ আমাদের সবশেষ সাক্ষাতে আমরা তা করিনি। আমরা জানি সে কতটা দৌড়ায়, সে বল পায়ে খেলতে পছন্দ করে আর এজন্য আমাদের সফল হতে রক্ষণে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে। আমরা যদি ব্রাজিলের বিপক্ষে যা করেছি তার পুনরাবৃত্তি করতে পারি, তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। তাছাড়া তারা তাদের নিয়মিত একাদশের দুইজনকে (মার্কোস অ্যাকুইনা ও গনজালো মন্টিয়েল) পাবে না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে আমাদের।’ সম্ভাবনার প্রদীপ মাঝেমধ্যে জ্বলেছে, কিন্তু ঝরাপাতার মতো মর্মর করুণ সুর তুলে তা হারিয়েও গেছে। সবশেষ সম্ভাবনার উঁকি ২০১৪ সালে, এই মেসিদের হাত ধরেই। কিন্তু ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে মারিও গোটসের একমাত্র গোলে জার্মানির কাছে হেরে স্বপ্ন ভাঙে আর্জেন্টিনার। ২০১৮ সালে মেসি আরও পরিণত। মারাকানার সেই দুঃখ ভুলে আশায় বুক বাঁধে আর্জেন্টিনা। দলটির সমর্থকদের স্বপ্নও আকাশচুম্বী। কিন্তু রাশিয়া বিশ্বকাপের পথচলার শুরুতে আইসল্যান্ড ধাক্কায় নড়ে যায় তা। এরপর ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ আসে দুঃস্বপ্ন হয়ে। এবারও সেই ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কোচ দালিচের মুখোমুখি আর্জেন্টিনা। নভগোরোদের স্মৃতি, প্রতিশোধের দুর্নিবার আকাক্সক্ষা মেসিদের মনে উঁকি না দিয়ে পারেই না! কিন্তু তা পূরণের পথ বড্ড কঠিন। ক্রোয়াটদের আছে লুকা মদ্রিচ, মাতেও কোভাচিচ, মার্সেলো বোরোভিচের মতো নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার। বলের নিয়ন্ত্রণে, কৌশলগত দিকে এই ত্রয়ী পাকা খেলোয়াড়। মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় নেয়ার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের আক্রমণের টান কেটে দিতে দারুণ পটু তারা। চার বছর আগের সুখস্মৃতির পুনরাবৃত্তি করতে মরিয়া থাকবে ক্রোয়াটরা। দলটির কোচ দালিচও হুঙ্কারের সুরে পাঠিয়েছেন বার্তা-মেসিদের নিয়ে ভীত নয় ক্রোয়েশিয়া। এবারই প্রথম দেখা হচ্ছে নকআউট পর্বে। কারোর সামনে জয়ের বিকল্প পথ খোলা নেই। ক্রোয়েশিয়ার চাই চার বছর আগের প্রাপ্তি, না কি মেসির আর্জেন্টিনার সাফল্য। তাইতো কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইলানটি ছড়াচ্ছে উত্তেজনার বাড়তি রেণু।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More