স্টাফ রিপোর্টার: উন্নয়নশীল দেশগুলোয় দাবি ও অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকরা উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি পালন করেন। সভা সমাবেশ ও লাল পতাকার মিছিলে রাজপথ মাতিয়ে রাখেন তারা। তবে এবারের মে দিবসের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। প্রায় সব দেশেই বন্ধ রয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এবার শ্রমিকদের মলিন মুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কাই বেশি। আজ পয়লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। মে দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘মালিক শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিব বর্ষে গড়বো দেশ।’ দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে, দেশের রিকশাচালক, গাড়িচালক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, ফুটপাতের ছোট ব্যবসায়ীসহ খেটে খাওয়া মানুষ এখন ঘরবন্দি। সুদিন ফেরার আশায় দিন গুনছেন তারা। সীমিত পরিসরে পোশাক কারখানা খুললেও সেখানে শ্রমিকরাও আছেন স্বাস্থ্য ও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। শ্রমজীবী মানুষরা এখন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে কাজে যেতে পারছেন না। বেকার হয়ে বসে আছেন দেশের লাখো দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ। তারা এখন বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছেন প্রতিদিন। করোনার কারণে দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা আজ হুমকির মুখে পড়েছে। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে সরকার গত ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে সর্বাত্মক ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে মানুষকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এতে একদিকে সংক্রমণ কমার আশা জাগছে, কিন্তু অন্যদিকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। করোনার প্রথম ধাক্কায় গত বছর সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এবার আরও ভয়াবহভাবে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানলেও সমাজের বিত্তশালীদের ত্রাণ তৎপরতায় দেখা যাচ্ছে না। সরকারও ত্রাণ বিতরণসহ খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম সেভাবে শুরু করেনি। এমন পরিস্থিতিতে কোটি মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে কঠিন সংকটে পড়েছে। তবে গেলো বছরের মতো এবারও করোনা মহামারির মধ্যে ৩৫ লাখ দরিদ্র পরিবার প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা পাচ্ছে। আগামীকাল রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সহায়তা কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে ৮৮০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা সরাসরি উপকারভোগীর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেয়া হয়েছিলো। এর ধারাবাহিকতায় চলমান করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৮৮০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী লোক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তারাই দিন আনে দিন খায় মানুষ। দেশের মোট ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজে আছেন। এর মধ্যে ৫ কোটির বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। অন্যরা আনুষ্ঠানিক খাতের। করোনায় তাদের জীবিকাও হুমকিতে আছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী লোকের মধ্যে কৃষি খাতে আছেন ২ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার, শিল্পখাতে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার এবং সেবা খাতে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ।
এই করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন খাত, যা অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। লাখ লাখ কারখানাশ্রমিক বেকার বসে আছেন।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে বিপুলসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে বসে আছেন। কাজ না থাকায় তাদের আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে গেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনায় দেশে এক কোটি ৬৮ লাখ মানুষ গরিব হয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ দরিদ্র ছিলো, বর্তমানে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, ট্রান্সপোর্ট, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মাঝামাঝি ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অভ্যন্তরীণ সেবা ও শিক্ষা প্রদানকারী সংস্থাগুলো। কম ঝুঁকিতে রয়েছে কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও তথ্য যোগাযোগ খাত।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘করোনায় দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, ফুটপাতের হকারসহ নিম্নআয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যা দরিদ্র মানুষের জন্য বাড়তি ও অসহনীয় চাপ তৈরি করেছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সারাদেশে শ্রমজীবী মানুষের বেতন কমেছে ৩৭ শতাংশ। ঢাকায় বেতন হ্রাস পেয়েছে ৪২ ও চট্টগ্রামে ৩৩ শতাংশ। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৬৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। দেশের ২০ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। ৬৯ শতাংশ চাকরিজীবী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন, যারা দেশের অর্থনীতিতে ৪৯ শতাংশ অবদান রাখেন।
উলেস্নখ্য, ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন ওই শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা। কিন্তু আন্দোলনরত শ্রমিকদের দমাতে মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় পুলিশ। এতে ১১ শ্রমিক নিহত হন। আহত ও গ্রেফতার হন আরও বহু শ্রমিক। পরে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকদের মধ্যে ছয়জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এতে বিক্ষোভ আরও প্রকট আকার ধারণ করে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর ১৮৯০ সাল থেকে পয়লা মে বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
এদিকে, এ বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দিবসটির সব কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। মহান মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় পত্রিকাসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দিনটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ও টকশো সম্প্রচার করবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ