আ.লীগে বাড়ছে বিদ্রোহী প্রার্থী : মদদদাতাদের তালিকা হয় : শাস্তি হয় না

আলোচনায় ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচন : শাস্তির বিষয়ে কঠোর অবস্থানের নির্দেশ সভাপতি শেখ হাসিনার
স্টাফ রিপোর্টার: স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আগের নির্বাচনের বিদ্রোহীরা এবার দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন না। এবার যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন, তাদেরও দল থেকে বহিষ্কার করা শুরু হয়েছে। তবে তাদের সমর্থনদাতা দলীয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের পর ৪০ জন কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যকে বিদ্রোহীদের মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। এই নির্বাচনে ৪২ শতাংশ নৌকার প্রার্থী পরাজিত হন। ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় মদদদাতাদের শাস্তির বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের পর এখন আবার বিদ্রোহীদের মদদদাতা নেতা, মন্ত্রী, এমপিদের তালিকা করার কাজ শুরু হয়েছে। ২৮ নভেম্বরের এই নির্বাচনে ৪৭ শতাংশ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। এক হাজার আট ইউপির মধ্যে ৪৪৬টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
এর আগে ২০১৯ সালের জুনে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ ওঠে অন্তত ৬০ জন মন্ত্রী, এমপিসহ দুই শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে। সে বছরের ১২ জুলাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় বিদ্রোহী ও তাদের মদদদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরে বিদ্রোহীদের কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু মদদদাতাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ফলে চলমান ইউনিয়ন ও পৌরসভা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানান, এমন পরিস্থিতিতে আবারও বিদ্রোহীদের সহযোগিতাকারীদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। আট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ তালিকা তৈরি করছেন। এই নেতারা মনে করছেন, এবার সত্যিই কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। না হলে দলে অন্তঃকোন্দল নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপও তাদের দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ইউপি নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে। তারা গত নভেম্বর মাসের সংঘাত ও হতাহতের তথ্য দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে সারা দেশ থেকে হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে প্রতি জেলায় অন্তত পাঁচ থেকে সাতটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছেন তারা। এসব অভিযোগের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে জমা দিয়েছেন তারা ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের পক্ষে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যাঁরা বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে দল এবার কঠোর হবে। মদদদাতা এমপিরা ভবিষ্যতে মনোনয়ন পাবেন না।
পার পেয়ে যান মদদদাতারা: সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আশানূর বিশ্বাস দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। হারের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোমিন ম-লের বিরোধিতাকে দায়ী করেন আশানূর বিশ্বাস ও তার স্বামী সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। মোমিন ম-লের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ খতিয়ে দেখেনি আওয়ামী লীগ।
ঢাকা বিভাগের গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে স্থানীয় সরকারের একাধিক নির্বাচনে নৌকার পরাজয়ের পেছনে দুজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন পরাজিত প্রার্থীরা। গত বছর আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর একাধিক সভায় মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ এক সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীকে মদদ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই মন্ত্রীকে সতর্ক করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে নমনীয় হন কেন্দ্রীয় নেতারা।
২০১৯ সালে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল আলম। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হন চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগারের ছোট ভাই আলি মুনছুর। আলী আজগারের বিরুদ্ধে তার ভাইয়ের পক্ষ নেয়ার অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দল। সংসদ সদস্যের ভাই আলী মনসুর দর্শনা পৌর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক থেকে সাধারণ সম্পাদক হন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, কে কতটুকু জড়িত তা যাচাই-বাছাই করে একটি তালিকা করতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে একটু সময় নিয়ে হলেও প্রমাণসহ তালিকা হবে। ফলে এবার কেউ শাস্তি এড়াতে পারবেন বলে মনে হয় না।
গত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কুমিল্লার হোমনায় মাথাভাঙ্গা ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নাজিরুল স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদের বিরুদ্ধে নৌকার বিরোধিতা করার অভিযোগ তুলেছেন। তবে কালের কণ্ঠের কাছে সেলিমা আহমেদ এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ স্থানীয় সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থীর বিরোধিতার অভিযোগ তোলেন। রাজী তার চাচা বিএনপির প্রার্থী এ এফ এম তারেকের পক্ষ নেন বলে অভিযোগ। সংসদ সদস্যের নিজের কেন্দ্রে নৌকা বড় ব্যবধানে পরাজিতও হয়। আবুল কালাম আজাদ কেন্দ্রে অভিযোগ করেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, এমপি, মন্ত্রীরা সমাজের সম্মানিত নাগরিক। শুধু অভিযোগের ভিত্তিতেই তো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তথ্য সংগ্রহ চলছে, পরে সিদ্ধান্ত হবে।
ঢাকা বিভাগের ঢাকা, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদীর একাধিক মন্ত্রী, কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। মাদারীপুরে তিন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে নৌকার বিরোধিতার অভিযোগ উঠেছে। টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নৌকাকে হারিয়ে দেওয়ার অভিযোগ কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয়েছে। বিগত পৌর নির্বাচনে নরসিংদী পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আমজাদ হোসেন। তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম নৌকার বিরোধিতা করে মোবাইল প্রতীকের প্রার্থীকে জয়ী করতে কাজ করেছেন। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ঢাকা বিভাগের যেসব জেলা, উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, এমপিরা নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন, তাঁদের তথ্য আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে দেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে অন্তত ১৬ জন নেতা, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া ও পাবনার একাধিক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গার একাধিক সংসদ সদস্য; বরিশাল বিভাগের বরিশাল, বরগুনা ও পিরোজপুর; সিলেট বিভাগে অন্তত পাঁচজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য; পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও কুড়িগ্রামের কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ কেন্দ্রে এসেছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More