চলে গেলেন রাজনীতির নক্ষত্র নূরে আলম সিদ্দিকী

ঝিনাইদহ ও ঢাকায় দুই দফা জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় দাফন

স্টাফ রিপোর্টার: চলে গেলেন রাজনীতির তেজোদীপ্ত আরেক নক্ষত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক বীর সিপাহসালার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী আর নেই। গতকাল ভোরে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৩ বছর। ঝিনাইদহ ও ঢাকায় দুই দফা জানাজা এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো শেষে রাতে সাভারে নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামসহ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতে ভূমিকা রেখে এক জীবন্ত ইতিহাস হয়ে ওঠা নূরে আলম সিদ্দিকীকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়। রাজনৈতিক সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন তার নামাজে জানাজায়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও বৃহত্তর যশোর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নূরে আলম সিদ্দিকীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রেসিডেন্ট তার শোক বার্তায় মরহুমের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নূরে আলম সিদ্দিকী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন এবং ৭০-এর নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতির এই সাহসী সন্তানের অবদান পরবর্তী প্রজন্ম চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ঢাকায় জানাজা ও শেষ শ্রদ্ধা: জন্মস্থান ঝিনাইদহে জানাজা ও সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেলে নূরে আলম সিদ্দিকীর লাশ নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। বাদ আসর গুলশান আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। রাজনৈতিক সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও সর্বস্তরের মানুষের পক্ষ থেকে জানানো হয় শ্রদ্ধা। পরিবারের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন মরহুমের বড় ছেলে ঝিনাইদহ-২ আসনের এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিকী। জানাজা শেষে নূরে আলম সিদ্দিকীকে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হয়।

জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ও জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আব্দুর রব সাংবাদিকদের বলেন, নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন অসীম বাগ্মী। তিনি তার ভাষায় জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য উজ্জীবিত করেছিলেন। ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। এই দেশ যতদিন থাকবে নূরে আলম সিদ্দিকীর নাম থাকবে। তিনি গণতন্ত্রের প্রতি অসীম দরদি ছিলেন। বাকশালের কারণে সে সময় যে তিনজন পদত্যাগ করেছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী তাদেরই একজন। তিনি কখনো আপস করেননি। ষাটের দশকের সব আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশ ছিল। জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে নূরে আলম সিদ্দিকী ততদিন মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। জানাজার আগে নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, আমার বাবা সবসময় সত্য ও ন্যায়ের পথে ছিলেন। তিনি কখনো আপস করেননি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে তার অসমান্য অবদানের কারণে দেশবাসী তাকে স্মরণে রাখবে।

ঝিনাইদহে জানাজা ও শেষ শ্রদ্ধা: গতকাল সকালে নূরে আলম সিদ্দিকীর লাশ হেলিকপ্টারে করে ঝিনাইদহ নিয়ে যাওয়া হয়। ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাকে শেষবার একনজর দেখার জন্য রাজনৈতিক কর্মী, সহকর্মী, সহপাঠীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ সেখানে ভিড় করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এর আগে তার রাজনৈতিক জীবনী নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই এমপি, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মকবুল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান, এডভোকেট ইসমাইল হোসেন ও ঝিনাইদহ জেলা বিএনপি’র সভাপতি এডভোকেট এমএ মজিদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

বঙ্গবন্ধু’র চার খলিফার অন্যতম নূরে আলম সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৪০ সালের ২৬ মে ঝিনাইদহে। বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্বে উপস্থিত, সেই সময় ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন মুজিববাহিনীর অন্যতম সংগঠক। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-২ আসন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের কালজয়ী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহাস্পর্শে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক চেতনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক মতাদর্শ তার রাজনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়ার রক্তাক্ত জামা নিয়ে ’৬৬-এর ৭ জুন ঢাকায় আইয়ুববিরোধী মিছিলের নেতৃত্বদানের মধ্যদিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে একজন বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য ছাত্রনেতা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭০-এর নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি হিসেবে তিনি যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখেন তা এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১-এর ১লা মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সব সভায় সভাপতিত্ব করার একক গৌরব তার। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব চতুষ্টয় আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার পর সেই পতাকাটি তিনি সগৌরবে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন।

নূরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। তার পিতা নূরনবী সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৬-এর জুনে ছয় দফার পক্ষে আয়োজিত হরতালে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৭ মাস কারান্তরালে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ওই বন্দিদশায়ই তিনি স্নেহময়ী জননী নূরুন নাহার সিদ্দিকীকে হারান। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে ট্রিপল এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালে আইনশাস্ত্রেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও শত অপমানে জর্জরিত হয়েছেন; প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে তাকে। নূরে আলম সিদ্দিকী আজীবন অন্যায়ের প্রতিবাদে ছিলেন সোচ্চার। নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করার পর তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি বাকশালের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে কিছুটা আড়ালে চলে গেলেও ব্যবসা ও শিল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত দেশসেবা করে গেছেন। তিনি ছিলেন প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাক্তন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এক ছাতার নিচে রাখতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এই সংগঠন। রাজনীতির মাঠের মতোই তিনি টকশোতেও ছিলেন এক বাগ্মি বক্তা। তার খুরধার লেখনীও সরব ছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মানবজমিন পত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন তিনি। এ পর্যন্ত তার পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে আছে, ‘একাত্তরের অজানা কাহিনি: এক খলিফার বয়ান’, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী নই, তবুও সমালোচনা করি’, ‘কালের কলধ্বনি’, ‘সংঘাত সংশয় সাফল্য’ ও ‘ইতিহাস একদিন কথা বলবেই’। একটি আত্মজীবনী প্রকাশেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় ওই প্রকাশনা আর দেখে যেতে পারেননি রাজনীতির এই দ্রুপদী।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More