জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা বাস্তবায়নে ১১ চ্যালেঞ্জ

স্টাফ রিপোর্টার: নতুন রূপরেখায় বদলে যাবে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই। নতুনত্ব আসবে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। সার্বিকভাবে নতুন এই রূপরেখায় বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে একেবারে মৌলিক হিসেবে প্রবর্তন করা হবে। ২০২৩ সালে এসব চালু হলেও আগামী বছর ২শ স্কুলে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হবে। এসব বিষয়ে কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন রূপরেখা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অন্তত ১১ ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। এগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে পাঠ্যবই এবং পাঠদান। এছাড়া আছে উপযুক্ত শিক্ষক; তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা মূল্যায়ন; দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন; শিক্ষকের হাতে দেয়া এই শিখনকালীন মূল্যায়নের স্বচ্ছতা; লেখাপড়ার মতো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় অভিভাবক ও সামাজিক মূল্যায়ন; উচ্চমাধ্যমিকে দুই পাবলিক পরীক্ষার চাপ; মাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা, ইতিহাস, ভূগোলের মতো বিষয়গুলোর পরিণতি; বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগের অনুপস্থিতিতে নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব। আরও আছে, মাধ্যমিকে বৃত্তিমূলক এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রায়োগিক বিষয় প্রবর্তন ও রূপরেখা বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ব্যয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, যে কোনো নতুনত্বই প্রথমে চ্যালেঞ্জ মনে হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতি পাঁচ বছর পরপর শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন ও যুগোপযোগী করা হয়ে থাকে। সেই হিসাবে আরও আগে আমাদের এ ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন ছিলো। কেননা, ২০১২ সালের পর পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন ধারণ আর আগামীতে বিশ্ব কোথায় যাবে- এসব বিবেচনায় নিয়েই নতুন শিক্ষাক্রম আনার চিন্তা করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যয় ও পরিশ্রমের প্রস্তুতি সরকারের আছে।
নতুন রূপরেখায় শিক্ষার্থীদের শেখার জন্য দশটি শিখন-ক্ষেত্র উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১৪টি বছর পড়ানো হবে এসব ক্ষেত্র থেকে। ৪ বছর বয়সে প্রাক-প্রাথমিক ‘মাইনাস টুতে’ (বিদ্যমান ধারণায় নার্সারি) ভর্তি হবে শিক্ষার্থীরা। এরপর উঠবে কেজি স্তরে। কিন্তু তাদের কোনো পাঠ্যবই থাকবে না। তবে বয়স অনুযায়ী ভাষা ও যোগাযোগ এবং গণিত ও যুক্তি থেকে শুরু শিল্প ও সংস্কৃতি পর্যন্ত দশটি বিষয়েই পাঠ শেখানো হবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নির্বাচিত বিষয় বা পাঠ্যবই থাকবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ৫টি আর উচ্চমাধ্যমিকে প্রতিবর্ষে ৭টি করে বিষয়ে পরীক্ষা থাকবে। এ ক্ষেত্রে সনাতনী পদ্ধতির বিভাগভিত্তিক পাঠ থাকছে না মাধ্যমিকে। মাদরাসা ও কারিগরি স্তরেও অভিন্ন পাঠ্যবই থাকবে। সব মিলে দেশে চালু হচ্ছে একমুখী শিক্ষা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূল হাতিয়ার হলেন শিক্ষকরা। কিন্তু দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব শিক্ষক নিযুক্ত আছেন কিংবা যে নতুন শিক্ষাক্রম আসছে তা বাস্তবায়নে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে প্রস্তুত করা কতটুকু সম্ভব সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রূপরেখায় ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা রাখা হয়নি। পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন কীভাবে হবে কিংবা শিখনকালীন মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটা কেমন হবে-সেটা নিয়েও অভিভাবকরা জানতে চাচ্ছেন। এছাড়া অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তও পরীক্ষার বদলে শিখনকালীন মূল্যায়ন রাখা হয়েছে ৬০ শতাংশ। আর এই মূল্যায়ন নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ও শঙ্কা হচ্ছে, কতটুকু নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এই মূল্যায়ন হবে। কেননা মূল্যায়নটি থাকছে বিদ্যালয়-মাদরাসার শিক্ষকদের হাতে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, রূপরেখাটি পর্যায়ক্রমে ২০২২ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। এজন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরিকল্পনাও এতে আছে। যেহেতু ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে তাই বিপুলসংখ্যক শিক্ষককে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত করা যাবে। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিমার্জন করা হবে। সেটা অনুযায়ী প্রাক-চাকরিকালীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষকের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে চাকরিকালীন এবং অব্যাহত পেশাগত উন্নয়ন কার্যক্রমও থাকবে। তিনি আরও বলেন, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন এক জিনিস নয়। তথাকথিত লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াও মূল্যায়ন সম্ভব সেটাই পরিকল্পিতভাবে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে আর দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন হারে থাকবে। মূল্যায়নের দায়িত্বে শুধু শিক্ষকের কাছে না রেখে বরং শিক্ষার্থী নিজে, সহপাঠী, তার অভিভাবক, এমনকি কমিউনিটিকেও স¤পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এই মূল্যায়নের প্রক্রিয়া এমন হবে যাতে প্রত্যেকেই নিজ পর্যবেক্ষণ থেকে নম্বরের বদলে গুণগত তথ্য দিয়ে মূল্যায়ন করবে।
প্রস্তাবিত রূপরেখায় ব্যবসায় শিক্ষা, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়গুলো নেই। অর্থাৎ, এ বিষয়গুলো আগের মতো আলাদাভাবে দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে রূপরেখা প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা বলছেন, বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে দশটি বিষয় সাজানো হয়েছে। তাই সাদা চোখে ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষার বিষয়গুলোকে আলাদা বিষয় হিসাবে দেখা না গেলেও এই বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে রাখা হয়েছে। এ দশটি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটি একাডেমিক বিষয় রাখা হয়েছে। বাকি পাঁচটি বিষয় সম্পূর্ণরূপে নির্দিষ্ট থিম ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে। ফলে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি একাডেমিক বিষয়গুলোও স্বতন্ত্র না থেকে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যদিকে মাধ্যমিকে সবার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগের বিভাজন না রাখা নিয়েও প্রশ্ন আছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। অনেকের মাঝেই প্রশ্ন, তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কমে যাবে কিনা। আর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা চাপের মুখে পড়ার ঝুঁকি আছে কিনা- এ প্রসঙ্গে রূপরেখার সদস্যরা জানান, রূপরেখা অনুযায়ী ১৬ বছর বয়সের পর ক্যারিয়ার ঠিক করে সেই অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বিষয় নির্বাচনের সুযোগ রাখা হয়েছে। কেননা, বর্তমানে কোনো শিক্ষার্থী কী পড়বে- নবম শ্রেণিতে তা অনেকটাই বাবা-মা চাপিয়ে দেন। এতে শিক্ষার্থীর মেধা, আগ্রহ, প্রবণতা ইত্যাদি বিবেচনা পায় না। অন্যদিকে এসএসসিতে বিভাগ হওয়ায় সমন্বিত শিক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের গুরুত্ব অন্য বিষয়গুলোর তুলনায় বেশি রাখা হয়েছে, যাতে সমন্বিত বিষয় হিসাবে থাকলেও এ বিষয়গুলো অধিক গুরুত্ব পায়। এটা অনুযায়ী শিখনসময় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বাংলা-ইংরেজির মতো সাধারণ বিষয়ে যত গুরুত্ব দেয়া হয়, নতুন পদ্ধতিতে তা কমিয়ে নৈর্বাচনিক বা বিভাগভিত্তিক বিষয়ে গুরুত্ব বেশি রাখা হয়েছে।
এদিকে বর্তমানে চালু থাকা সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি থাকছে না। বিভিন্ন আদলে মূল্যায়নের পাশাপাশি এমসিকিউ এবং বর্ণনামূলক প্রশ্নও থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত হতে পারবে কিনা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পরপর পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ আনবে কিনা- সেটাও অভিভাবকদের বড় প্রশ্ন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে শিক্ষার্থীদের চাপ না বেড়ে বরং কমার সম্ভাবনা বেশি। কেননা, প্রচলিত পদ্ধতিতে দ্বাদশ শ্রেণির শেষে শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে দুই বছরের পাঠের ওপর পরীক্ষা দিতে হয়, যা তাদের জন্য বড় ধরনের চাপ। এখন আলাদাভাগে পরীক্ষা হওয়ায় এ চাপ অনেক কমে আসবে। পাশাপাশি একাদশ শ্রেণির কোনো কোর্সে রেজাল্ট খারাপ হলে পরের বছর পরবর্তী ব্যাচের সঙ্গে সেই কোর্সের মানোন্নয়ন পরীক্ষার সুযোগ থাকছে।
নতুন রূপরেখা বাস্তবায়নে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অনেকেই বলতে চাচ্ছেন যে, শিক্ষাক্রম রূপরেখা উচ্চাভিলাষী। তা নয়, বরং বাস্তববাদী। এটি যেহেতু রাতারাতি বাস্তবায়িত হবে না, তাই অতিরিক্ত কোনো বাজেট প্রয়োজন হবে না। প্রথমত নতুন কোনো বিষয় প্রস্তাব করা হয়নি। বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য যে ট্রেড চালু করার কথা এসেছে সেই খাতে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষক-সহায়িকাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের অর্থ বরাদ্দ সরকারের পরিকল্পনায় আছে, সেই সক্ষমতাও রয়েছে। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিদ্যমান সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা না থাকলেও যেটা আসবে তাতে তাদের সমস্যা হবে না। আনুষ্ঠানিক শিখন কার্যক্রমে অভিভাবক ও সমাজের সম্পৃক্ততা শিক্ষার্থীর একাডেমিক উন্নতির জন্য নয়। বরং তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তার (শিক্ষার্থীর) যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করাই এ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More