স্টাফ রিপোর্টার: করোনা সংক্রমণের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। কিন্তু সেই লেখাপড়ার জন্য তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবো কিনা, তা আমাদের বিরোধীদলীয় সংসদ উপনেতা একটু বিবেচনা করবেন।’
শনিবার জাতীয় সংসদের ১৩তম ও বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সমাপনী বক্তব্যের আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন। জবাবে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে শিক্ষকদের টিকা দিয়েছি। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী কোনো টিকা কোন বয়সে দিতে হয়, সেটা অনুসরণ করতে হয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ইতোমধ্যে আমরা শিশুদের টিকাদান শুরু করেছি। টিকা দেয়া শেষ হলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধ। কিন্তু পড়ালেখা যাতে বন্ধ না হয়, এজন্য সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লাস চালানো হচ্ছে। এছাড়া আমরা রেডিও উন্মুক্ত করে দিয়েছি। রেডিওর মাধ্যমে যাচ্ছে, অনলাইনে যাচ্ছে। যে যেভাবে সুযোগ পারছেন, পড়ালেখা করছেন। আমরা পড়াশোনা চালিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমরা বলবো, একটু ক্ষতি হচ্ছে। অনেক শিশুও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের কথা ভাবতে হবে। টিকা দিয়ে আমরা কিন্তু সব স্কুল খুলে দেবো। যদিও আমরা যখন ঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম খুলবো, তখনই করোনা এমনভাবে মহামারি আকারে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো; তার ধাক্কাটা এলো আমাদের দেশে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যায়, তারা কিন্তু তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চান না। তবে যাদের ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে না, ইদানিং সবচেয়ে বেশি সোচ্চার তারা। পড়ানোর মতো ছেলেমেয়ে নেই, তারাই বেশি কথা বলে। কিন্তু যারা যায় তারা তো চাচ্ছেন না।’
বিরোধীদলীয় উপনেতাকে উদ্দেশ্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বলার জন্য বলবেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন কি? আমাদের অনেক পরিচিতজন বিদেশে পড়ালেখা করে। আমার নাতিরা পড়ালেখা করে। সেখানে অনলাইনে পড়ালেখা চলে। কিছুদিন স্কুল খুললো, আবার যখন মহামারি ছড়িয়ে পড়লো তখন আবার বন্ধ। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়। এটা সারাবিশ্বে একই অবস্থা। এটা সবাইকে মানতে হবে।’
শিক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘করোনায় এমন কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই, যাদের সাহায্য দেয়া হয়নি। যেহেতু আবার করোনা দেখা দিয়েছে, আমরা সাধ্যমতো সাহায্য করবো। কারও খাদ্য ঘাটতি যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখছি।’
সবার জন্য বিনামূল্যে টিকা: বিশ্বের যে দেশেই করোনার টিকা আবিষ্কার হচ্ছে সেই দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হচ্ছে-এমন মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, যত লাগে টিকা কিনবো। তার জন্য বাজেটে আলাদা টাকা রাখা আছে, এজন্য কোনো চিন্তা করতে হবে না। তিনি বলেন, টিকা আসতে শুরু হয়েছে, কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছি ৮০ ভাগ লোককে টিকার আওতায় নিয়ে আসবো। আর সব টিকা বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে।
টিকা প্রসঙ্গে সংসদ নেতা বলেন, টিকার একটু সমস্যা হয়েছিলো ভারত থেকে টিকা রফতানি বন্ধ করাতে। বর্তমানে টিকা এসে গেছে। ফাইজারের টিকা যেটা এসেছে, যারা বিদেশে শ্রমিক যাচ্ছে তাদের অগ্রাধিকার থাকবে এই টিকা পাওয়ার। বৃহস্পতিবার রাতে এবং আজ (শনিবার) খুব ভোরে মডার্না এবং সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। মডার্না থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন চলে আসছে। সিনোফার্মের ২ মিলিয়ন এসেছে। সিনোফার্মের টিকা কিন্তু ক্রয় করেছি তার আগে চীন থেকে কিছু উপহার পাঠানো হয়েছে। ভারতও কিছু উপহার দিয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি পালনে উপেক্ষায় হতাশ প্রধানমন্ত্রী: করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকার সম্ভাব্য সবকিছু করলেও স্বাস্থ্যবিধি পালনে মানুষের উদাসীনতা দেখে হতাশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আবারও সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তাহলেই মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কোরবানির ঈদের আগে রোজার ঈদের কথা স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা সমস্যা হচ্ছে যে জনগণকে গত ঈদুল ফিতরে বারবার অনুরোধ করলাম যে আপনারা আপনাদের জায়গা ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু অনেকেই তো সেই কথা শোনেনি। সবাই ছুটে চলে গেছে। আর তার ফলাফলটা কী হলো? যারা বাইরে ছিল, পুরো বর্ডার এলাকায়, বিভিন্ন জেলায় এই করোনাটা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই তখন যদি আমার কথাটা শুনত, তাহলে আজকে এমনভাবে করোনাটা ছড়িয়ে পড়ত না।’
মানুষের বাড়ি যেতে চাওয়ার প্রবণতাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সংক্রমণ এড়াতে মহামারিকালে সবাইকে এক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারি প্রতিরোধে সরকার যেসব নির্দেশনাগুলো দিয়েছে, সেগুলো মেনে চললে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আমরা এখন লকডাউন ঘোষণা করেছি। আমি দেশবাসীকে বলব, আপনারা অন্ততপক্ষে নির্দেশনাগুলো মেনে নিজেকে সুরক্ষিত রাখেন, অন্যকে সুরক্ষিত রাখেন। অন্তত এটা ছড়াতে দিয়েন না।
হাসপাতালে অক্সিজেনের যেন সমস্যা না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যান্ত্রিক কিছু ত্রুটি হলেও বিকল্প ব্যবস্থা রাখার কথা বলেন তিনি। অক্সিজেনের অভাবে মারা যাওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি হাসপাতালের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি। একেক সময় একটা জায়গায় হঠাৎ সমস্যা চলে আসে। আবার মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি হয়। এর কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন, আমি তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। তবে এ রকম ত্রুটি যাতে না দেখা দেয় বা হলেও যাতে বিকল্প থাকে, ইনশাআল্লাহ সে ব্যবস্থা আমরা করবো।’
কোরআনে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে : কোরআন শরিফে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে সংসদের এই অধিবেশনেই বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকার সমালোচনা করেছিলেন। কোরআনে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা নেই বলে তিনি দাবি করেছিলেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করেছিলেন বিএনপির এই সংসদ সদস্য।
হারুনের বক্তব্যের প্রসঙ্গটি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাননীয় সংসদ সদস্য বলেছেন, কোরআন শরিফে নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা নেই। আমি বলব অবশ্যই আছে। আমাদের নবী করিম (সা.) বলেছেন, অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে। তিনি এই শিক্ষা দিয়েছেন। আমাদের কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম সব ধর্মের মর্যাদা দেয়। কোরআন শরিফে আছে ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন’ অর্থাৎ যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। যার যার মতামত সে সে প্রকাশ করবেন। এটা প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষতাই আসে। যতই তিনি (এমপি হারুনুর রশিদ) অস্বীকার করুন, যেভাবে তিনি ব্যাখ্যা দেন। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। যুগ যুগ ধরে এটা চলছে। হ্যাঁ অবশ্যই নিজের ধর্ম পালনে সব সময় গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল থাকতে হবে। এটা আমাদের শিক্ষা। এটা নবী করিম (সা.) সব সময় বলে গেছেন। কাজেই এ ধরনের কথা সংসদে না বলাটাই ভালো।’
জিয়া-খালেদা-এরশাদ একই বৃত্তের কয়েকটি ফুল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী এক সেনা শাসকের পকেট থেকে যে দলের সৃষ্টি তারা গণতন্ত্রের কী বোঝে? কোন গণতন্ত্র শেখাবে? তারা কি গণতন্ত্র শেখাবে আমাদের? আজ তাদের মুখেই শুনতে হয় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। যাদের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে, কুর্দি পরে। জিয়া-খালেদা জিয়া-এরশাদ একই বৃত্তের কয়েকটা ফুল। তিনি আরও বলেন, কুর্দি পরে ক্ষমতায় এসে তার আবার শখ হল রাজনীতিবিদ হওয়ার। কুর্দি পরে ক্ষমতায় এসে রাজনীতিতে নামলেন, আর সেই দলই হলো বিএনপি। বিএনপির অর্থ হলো বি-বাংলাদেশ, এন-না, পি-পাকিস্তান হ্যাঁ এই তো বিএনপি। এই হলো তাদের রাজনীতি, এই হলো তাদের গণতন্ত্র।
শেখ হাসিনা বলেন, যদি বিএনপির আমল আর এরশাদের আমলের কাহিনী বলতে থাকি তাহলে অনেক সময় লেগে যাবে। জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে প্রতি রাতে কারফিউ দিয়েছিলো। ১৯৮০ সালে যখন বাংলাদেশে আসি তখন শুনি কারফিউ। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কারফিউ। বিএনপি কি গণতন্ত্র দিয়েছিলো, জিয়াউর রহমান দিয়েছিলো কারফিউ গণতন্ত্র। হ্যাঁ অনেকগুলো দল করার সুযোগ দিয়েছিল এটা ঠিক, কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিলো না। আর নির্বাচনের ফলাফল তা আগেই ঠিক করা থাকতো। ১৯৭৮ সালের হ্যাঁ-না ভোট ’৭৯ সালের নির্বাচন সবই ছিলো খেলা। তার পরবর্তীতে যদিও আসেন এরশাদ সাহেব। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ৪৮ ঘণ্টা ভোটের ফলাফল আটকে রেখে আওয়ামী লীগকে হারালো। আসলে জিয়া-খালেদা জিয়া-এরশাদ সব একই বৃত্তের কয়েকটি ফুল।
খালেদা জিয়ার আমলে নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, খালেদা জিয়া তারাও একই কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন। সেই নির্বাচন পরিচালনা করেছিলো বিচারপতি সাদেক আলী, কোনো ভোটার নেই, চারদিকে আর্মি দিয়ে কোনো ভোটার যেতে পারলো না কিন্তু ভোট হয়ে গেলো। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় বসেছিলো। এরপর ৩০ মার্চ জনগণের আন্দোলনে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারপর জুন মাসের ১২ তারিখে যে নির্বাচন হয়, সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। আমাদের সঙ্গে অন্যান্য পার্টিও এসেছিলো যেমন জাতীয় পার্টি, আ স ম আব্দুর রব ছিলো। ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো যারা নির্বাচন করতে পারে জনগণের আন্দোলনে যারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় তারা কীভাবে গণতন্ত্র দিয়েছে, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কি বুঝাবে সংসদে আমাদের।
পরবর্তী পোস্ট
এছাড়া, আরও পড়ুনঃ