পিইসি বাতিল : ফিরে এলো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা

সিলেবাস-মানবণ্টন ঠিক না করেই পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ অভিভাবক-শিক্ষকরা

স্টাফ রিপোর্টার: প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা আর হচ্ছে না। তেরো বছর পর বৃত্তি পরীক্ষা ফিরে আসছে সেই আগের নিয়মে। প্রতিটি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণির অন্তত ১০ ভাগ শিক্ষার্থীকে এ পরীক্ষায় পাঠাতে হবে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্তের কথা লিখিত আকারে জানানো হয় মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের। এদিকে অনেকটা আকস্মিক এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে। কেননা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ মাসের শেষ সপ্তাহে বৃত্তি পরীক্ষা নিতে হবে। মাত্র তিন সপ্তাহ সময় থাকতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবাই একরকম হতবাক। কেননা বৃত্তি পরীক্ষা নিতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক ধরনের দীর্ঘ প্রস্তুতির বিষয় থাকে। সেটি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যে কারণে এ সেক্টরের বিশ্লেষকসহ সংশ্লিষ্টরা এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। প্রসঙ্গত, সর্বশেষ বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০০৮ সালে। এরপর ২০০৯ সালে পিইসি পরীক্ষা চালু করা হয়। এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়া হতো সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী শনিবার বলেন, বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত অনেকটা তাড়াহুড়ো করে নেওয়া হয়েছে। কেননা এত অল্প সময় দিয়ে বৃত্তি পরীক্ষার মতো মেধা যাচাই ও পুরস্কৃত করার মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার তারিখ এভাবে ঘোষণা করা সমীচীন হয়নি। তবে এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রকারান্তরে পিইসি পরীক্ষাযুগের সমাপ্তিকে তিনি সাধুবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন, অতীতে বৃত্তি পরীক্ষার নামে পঞ্চম শ্রেণিতে আলাদা ক্লাসরুম করার রেওয়াজ দেখা গেছে। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হতো। এর ফলে কিছু শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো। তাছাড়া সরকার আগামী বছর ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে এই বৃত্তি পরীক্ষা সাংঘর্ষিক হবে কিনা-সেটি খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি। শিক্ষক ও অভিভাবকদের কেউ কেউ বলছেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার আদেশ কমপক্ষে ২-৩ মাস আগে দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারত। করোনার মতো বিশ্ব ওলটপালট করে দেওয়া একটি মহামারি পরিস্থিতিতে প্রায় আড়াই বছর শিক্ষার্থীরা সরাসরি ক্লাসরুমে লেখাপড়া করতে পারেনি। এ কারণে তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে শিখনঘাটতি তৈরি হয়েছে। সেটির দিকে নজর না দিয়ে এভাবে পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়ায় শিক্ষক-অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়বে। আবার কিছু অভিভাবক অবশ্য বৃত্তি পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। শুক্রবার প্রকাশিত বৃত্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সরকারি আদেশে বলা হয়, প্রাথমিক বৃত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে পিইসির বিকল্প হিসাবে মেধা যাচাই পদ্ধতি নির্ণয়ের জন্য গত ২৮ নভেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রচলিত মেধাবৃত্তি দেওয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এই বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে। পরীক্ষা নেওয়া হবে প্রতিটি উপজেলা সদরে। তাই পরীক্ষার্থী ও কেন্দ্র সংখ্যা ঠিক করে আগামী ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ই-মেইলে ডিপিই’র সাধারণ প্রশাসন শাখায় জানাতে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসনকে জানাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে একটি তথ্য ছক দেওয়া হয়েছে। তাতে জেলা ও উপজেলার নাম, ৫ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর তথ্য (বালক-বালিকা-ইংরেজি ভার্সন) এবং মোট শিক্ষার্থীর ১০ শতাংশ হিসাবে কেন্দ্র সংখ্যা জানাতে বলা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করে দুজন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, তারা চিঠি পেয়েছেন। ডিপিই’র চাহিদা অনুযায়ী তথ্য ছক তৈরি করছেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির অন্তত ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। সর্বোচ্চ শতভাগ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষায় বসতে পারবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অনলাইন প্রাথমিক শিক্ষা সমিতির আহ্বায়ক ফরিদ আহমেদ বলেন, করোনায় শিখনঘাটতি নিয়ে যখন শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, শিক্ষক-অভিভাবকরাও দুশ্চিন্তায় আছেন, তখন মাত্র অল্প কয়েকদিন হাতে রেখে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সিলেবাসে কী থাকবে, মানবণ্টন কেমন হবে এসবের কিছুই শিক্ষকরা জানেন না। এর মধ্যে আবার ৮ ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে ক্লাস্টারভিত্তিক (এক বা একাধিক ইউনিয়নের স্কুল নিয়ে একটি গুচ্ছ) মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হবে। তার মধ্যে এমন একটি ঘোষণা শুধু ‘হযবরল’ই সৃষ্টি করবে না, অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভেরও সৃষ্টি করবে। তিনি আরও বলেন, আসলে প্রাথমিক শিক্ষায় একটি তুঘলকি কা- ঘটছে। একই বিষয়ে সকাল-বিকেল আলাদা নির্দেশনা জারি হয়। আর আমাদের তা প্রতিপালন করতে হয়। জানতে চাইলে ডিপিই মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত অবশ্য বলেন, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন এমনিতেই হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস্টারভিত্তিক অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এর ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের পরবর্তী ক্লাসে পদোন্নতি দেওয়া হবে। যেহেতু তারা লেখাপড়া করছে আর এ বছরে তারা যতটুকু লেখাপড়া করতে পেরেছে তার ওপরই পরীক্ষা নেওয়া হবে। যেহেতু প্রাথমিক বৃত্তি যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি ঐতিহ্য। সেটি ধরে রাখার লক্ষ্যে পরীক্ষা নিয়ে বৃত্তিটা দেয়া হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ৫ ও ৬ জুন যথাক্রমে জেএসসি-জেডিসি এবং পিইসি ও ইইসি (ইবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষা) এ বছর না নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ২০০৯ সালে প্রথম জাতীয়ভাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য পিইসি পরীক্ষা শুরু করে সরকার। পরে ইইসি পরীক্ষাও শুরু করা হয়। এরপর অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১০ সালে শুরু হয় জেএসসি পরীক্ষা। পরে মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয় জেডিসি পরীক্ষা। কিন্তু এসব পরীক্ষা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক ছিল। এতে নোট-গাইড আর কোচিং ব্যবসা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। পাশাপাশি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ায় অনেক অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা অসন্তুষ্ট হন। বিশেষ করে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে পরীক্ষাগুলোর কথা উল্লেখ না থাকায় সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি ছিল। সবমিলে পরীক্ষা বাতিলের দাবি করে আসছিলেন সবপক্ষ। এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতিতে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় নাভিশ্বাস ছেড়েছিলেন তারা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More