ফের বাড়লো বিদ্যুতের দাম : আজ থেকে কার্যকর

গ্রাহকের পাশাপাশি এবার পাইকারি পর্যায়েও বৃদ্ধি

স্টাফ রিপোর্টার: মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধানে ফের বাড়লো বিদ্যুতের দাম। এবার নির্বাহী আদেশে গ্রাহকের পাশাপাশি পাইকারি পর্যায়েও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি দর আজ বুধবার থেকে কার্যকর হবে। এ দফায় গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ এবং পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। দাম বাড়িয়ে ৩০ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে সেটি গোপন রাখা হয়। ৩১ জানুয়ারি সকালে তা প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এভাবে ঘন ঘন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। মাত্র ১৮ দিন আগে ১২ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এর আগে বিইআরসি ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ায়। তখন ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে এক লাফে গড়ে ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে সরকার একের পর এক পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে যাচ্ছে। আগে দাম বাড়ানোর এই প্রক্রিয়া থেকে হতদরিদ্র ও কৃষি-সেচকে বাদ রাখা হতো। এখন সেখানেও হানা দিচ্ছে সরকার। সাত মাসে ৭ বার বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম। এর প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে গিয়ে মান কমে যাচ্ছে। ব্যয় ভারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সঙ্গে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি হয়েছে।

এবারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পাইকারি দর বাড়িয়ে ২৩০ কেভিতে ৮.১০ টাকা, ১৩২ কেভিতে ৮.১৩ টাকা এবং ৩৩ কেভিতে ৫.৮৯ টাকা করা হয়েছে। ২৩০ ও ১৩২ কেভিতে অভিন্ন দর নির্ধারণ করা হলেও ৩৩ কেভিতে ভিন্ন ভিন্ন দাম ধরা হয়েছে। ডিপিডিসির ৩৩ কেভিতে ৮.২২ টাকা, ডেসকো ৮.২৪ টাকা, ওজোপাডিকো ৭.১২ টাকা এবং নেসকোতে ৬.৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে গত তিন সপ্তাহে তিন দফায় গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘটনা ঘটলো, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। আগে কখনই এত কম সময়ের ব্যবধানে এভাবে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হয়নি। এর ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

অন্যদিকে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী লাইফ লাইন (৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী) গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম এর আগে ১৯ পয়সা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করা হয়েছিলো। এবার আরও ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়। প্রথম ধাপে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যমান দর ৪.৪০ টাকা বাড়িয়ে ৪.৬২ টাকা, দ্বিতীয় ধাপে ৭৬-২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ৬.০১ বাড়িয়ে ৬.৩১ টাকা, ২০১-৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ৬.৩০ টাকা বাড়িয়ে ৬.৬২ টাকা ৩০১-৪০০ ইউনিটের বিদ্যমান দর ৬.৬৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬.৯৯ টাকা, ৪০১-৬০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যমান দর ১০.৪৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০.৯৬ টাকা, সর্বশেষ ধাপ ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ব্যবহারকারীদের বিদ্যমান দর ১২.০৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২.৬৩ টাকা করা হয়েছে।

কৃষি সেচে ১২ ডিসেম্বর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়েছিলো, এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে। শিক্ষা, ধর্মীয়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে ৬.৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬.৬৪ টাকা, রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পে ৮.০৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৪৯ টাকা, বাণিজ্যিক ও অফিসের বর্তমান দর ফ্ল্যাট রেটে ১০.৮২ টাকা বাড়িয়ে ১১.৩৬ টাকা, অফ-পিকে ৯,৭৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০.২২ টাকা পিকে ১২.৯৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩.৬৩ টাকা করা হয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পে (নিচাপ) ফ্ল্যাট রেটে ৯.৪১ টাকা, অফপিকে ৮.৪৬ টাকা, পিকে ১১.২৯ টাকা দর ধরা হয়েছে।

মধ্যম চাপে শিল্প গ্রাহকদের ফ্ল্যাট রেটে ৯.৪৩ টাকা, অফ-পিকে ৮.৪৯ টাকা, পিকে ১১.৭৮ টাকা করা হয়েছে। উচ্চচাপ (৩৩ কেভি) গ্রাহকদের ফ্ল্যাট রেটে ৮.৮৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯.৩১ টাকা, অফ-পিকে ৭.৯৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৩৯ টাকা এবং পিকে ১১.০৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১.৬৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর ১৮ মে গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বর্তমান দর ইউনিট প্রতি ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার আবেদন করেছিল। বিপিডিবির পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলেছিল, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে। ওই শুনানির পর ১৯.৯২ শতাংশ পাইকারি দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়।

সূত্র জানায়, জুন থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে দুই দফা। প্রতি দফায়ই এর দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। গত ৫ জুনে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ১৮ জানুয়ারি বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। এর ৭ দিন আগে ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ শতাংশ। ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত বছরের ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। একই বছরের ১ আগস্ট সারের দাম বাড়ানো হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। গত সাড়ে সাত মাসে ৪ ধরনের সেবার দাম ছয় দফায় বাড়ানো হয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সব খাতে। শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম। যা মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। একইসঙ্গে গণপরিবহণ ও পণ্য পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে লাগামহীনভাবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে গ্যাস দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেছে। ব্যাটারিচালিত গণপরিবহণের ভাড়াও বৃদ্ধি পাবে। শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি ক্যাপটিভ পাওয়ার। সেই ক্যাপটিভ পাওয়ারের দাম একলাফে ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল ১২ জানুয়ারি। প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকার জায়গায় এখন দিতে হবে ৩০ টাকা। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন শিল্পমালিকরা। কিন্তু এখনো নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছে না গ্রাহকরা।

সেচ গ্রাহক ও হতদরিদ্ররা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত : বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবারই প্রথম হতদরিদ্র ও কৃষি সেচকে কোনো ধরনের গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কৃষি উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এ খাতে বিদ্যুতের দাম সব সময়েই সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। এবার সেখানেও হানা দেওয়া হয়েছে। সার-বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় আসন্ন বোরো মরসুম নিয়ে এমনিতেই শঙ্কায় রয়েছে কৃষকরা। তারপর সেচে দফায় দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়েছিল, এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে। কৃষিতে মধ্যম চাপে ফ্ল্যাট রেটে ৫.৫১ টাকা, অফ-পিকে ৪.৯৭ টাকা এবং পিকে ৬.৮৯ টাকা করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়নি রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পের বিলেও। দুই দফায় দাম বাড়িয়ে ৮.৪৯ টাকা করা হয়েছে।

ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য সাশ্রয়ী দরের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফ্ল্যাট রেটে ৯.৪১ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে যা বৃহৎ শিল্পের তুলনায় মাত্র ২ পয়সা কম। বৃহৎ শিল্পে ফ্ল্যাট রেটে দর ধরা হয়েছে ৯.৪৩ টাকা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত হতো। সমাজের পিছিয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার চেষ্টা থাকত। মূল্যহারের অভিঘাত থেকে হতদরিদ্র গ্রাহক, গ্রামের পান-বিড়ির দোকান, কৃষি সেচকে বাইরে রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু নির্বাহী আদেশে সেসব চর্চা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এ কুফল অনেক ভয়াবহ হবে বলেও তিনি জানান।

তিনি আরও বলেন, যে হারে দাম বাড়ানো হচ্ছে এর ফল উলটো হবে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল, হিতের বিপরীত হতে পারে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম যত বাড়বে, বাজারে পণ্য বিক্রি কমে যাবে, এতে কমে আসবে সরবরাহ। কমে যাবে ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে আয়। ড. শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা আগেও বলেছি এখনো বলছি দাম না বাড়িয়েও সামাল দেওয়ার অনেক বিকল্প ছিলো।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More