বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
ওয়াশিংটনে মোমেন-নুল্যান্ড বৈঠক জুড়েই ছিলো নির্বাচন প্রসঙ্গ
র্যাবর ওপর নিষেধাজ্ঞা আবারও প্রত্যাহার করতে বলেছে ঢাকা
স্টাফ রিপোর্টার: ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্ব সংলাপ জুড়েই ছিলো নির্বাচন প্রসঙ্গ। সংলাপে সবার অংশগ্রহণে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আকাক্সক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই নির্বাচনে জনমতের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটবে বলে আশা করে ওয়াশিংটন। বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বন্ধে সরকারের চলমান পদক্ষেপগুলোর সফলতা কামনা করে বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের তাগিদ দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এমনটাই জানিয়েছে দায়িত্বশীল কূটনীতিক সূত্র।
সংলাপে বাংলাদেশের তরফে র্যাবের ওপর থেকে বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দ্রুত হস্তান্তরের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। বুধবার ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র নবম পার্টনারশিপ ডায়ালগে উপরোল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা এবং দাবি, পাল্টা দাবি করা হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড।
এদিকে গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের অত্যাসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান খোলাসা করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিনকেন। বৈঠকের উদ্বোধনী সেশনে (অন রেকর্ড) ব্লিনকেন বলেন ‘বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র তো অবশ্যই, সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে।’ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যাতে এ অঞ্চল এবং সারাবিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ তৈরি করতে পারে সেই আকাক্সক্ষাও ব্যক্ত করেন তিনি। মন্ত্রী পর্যায়ের সেই বৈঠকের পর এবার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বাৎসরিক আলোচনার ফোরাম অংশীদারিত্ব সংলাপে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও স্পষ্ট করা হলো। সংলাপ শেষে প্রচারিত এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রতিনিধিদলের প্রধান ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, যখন আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করছি, সেই সময়ে পররাষ্ট্র সচিব মোমেনের (সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন) সঙ্গে বৈঠক হলো। আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনসহ মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছি। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। এদিকে পার্টনারশিপ ডায়ালগের যৌথ বিবৃতির বিষয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় আলাদা আলাদা বিবৃতি প্রচার করেছে ঢাকা এবং ওয়াশিংটন।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক কোভিড পরিস্থিতির কারণে ৩ বছর বিরতির পর ২০২২ সালের মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৮ম পার্টনারশিপ ডায়ালগেও এমন মতভিন্নতা ছিলো। মোমেন-নুল্যান্ড সেবারই প্রথম পার্টনারশিপ ডায়ালগে বসেছিলেন। করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুনে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত ৭ম অংশীদারিত্ব সংলাপ সর্বশেষ যৌথ বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ডেভিড হেইল ওই সংলাপে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এতে দু’দেশের সরকার নিরাপত্তা, উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগকালীন ত্রাণ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ওপর জোর দিয়ে টেকসই অংশীদারিত্বের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছিলো। দু’দেশের সরকার একটি অবাধ, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিষয়ে অভিন্ন লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা চালাতেও সেই বৈঠকে একমত হয়েছিল।
মার্কিন মুখপাত্রের বিবৃতির বিস্তারিত : সংলাপের পর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের রিডআউট স্টেটমেন্টে বলা হয়, ৩রা মে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার নবম অংশীদারিত্ব সংলাপ হয়েছে। এতে উভয়পক্ষই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আতিথেয়তার জন্য বাংলাদেশকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যেকার শক্তিশালী সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব এবং বাংলাদেশে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। সেই সঙ্গে দুই দেশের জনগণের সুদৃঢ় বন্ধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আরও উজ্জ্বল অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এর ইতিবাচক পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ঢাকার বিবৃতিতে সংলাপ বিষয়ে যা বলা হয়েছে: ওদিকে ঢাকার বিবৃতিতে জানানো হয়, বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মিস্টার মোমেন বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে অংশীদারিত্বের ৫০ বছর উদ্যাপনে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর এবং তারও আগে সরকার প্রধানের জাপান সফরের বিষয়ে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে অবহিত করেন। তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক বিষয়েও ব্রিফ করেন। জবাবে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিষয়ক দলিলে অনেক বিষয়ে অভিন্নতা রয়েছে। সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণার পর বুধবারই প্রথম ওয়াশিংটনের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করলো ঢাকা। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াও স্পষ্ট হলো এই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ১৫ দফার রূপরেখা প্রকাশ করা হয়। ওই রূপরেখায় মূলত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বার্থে নিরাপত্তা পূর্বশর্ত- এ বিষয়ে জোর দেয়া হয়। পাশাপাশি এ অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় কোনো পক্ষে ঝুঁকে না পড়ার বিষয়ও এতে স্পষ্ট করা হয়। ২৫ থেকে ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুনবাগিচার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্র সচিব মোমেন তার মার্কিন কাউন্টার পার্টকে বাংলাদেশের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্তকরণে নির্বাচন কমিশন গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট অঙ্গীকারের পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণের পথ উন্মুক্ত করার প্রশংসা করা হয়। পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মানবাধিকার কর্মকান্ডের কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি শেয়ার করেন। তিনি র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে হস্তান্তরের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। রাষ্ট্রদূত নুল্যান্ড বাংলাদেশ সরকারের এই বছরের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনার ঘোষণাকে স্বাগত জানান। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বর্ধিত বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য শ্রম খাতের সংস্কারের সঙ্গে অব্যাহত অগ্রগতির গুরুত্বের উপর জোর দেন। উভয়পক্ষ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ক্রমবর্ধমান এবং প্রাণবন্ত ব্যবসায়িক সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা বাংলাদেশে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের ব্যবসায়িক ব্যস্ততা বাড়াতে সাইবার নিরাপত্তা এবং ডেটা সুরক্ষায় আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যেতে সম্মত হন। রাষ্ট্রদূত নুল্যান্ড মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অসাধারণ উদারতার প্রশংসা করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত মানবিক সহায়তার আশ্বাস দেন। পররাষ্ট্র সচিব মোমেন রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং সীমিত সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে গৃহীত নতুন পাইলট প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত করেন। উভয়পক্ষই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু রোহিঙ্গার পুনর্বাসন কার্যক্রমকে আরও বাড়াতে সম্মত হন। উভয়পক্ষ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের মতামত বিনিময় এবং এ বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। পররাষ্ট্র সচিব মোমেন আন্ডার সেক্রেটারি নুল্যান্ডকে আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় অংশীদারিত্ব সংলাপের দশম রাউন্ডে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। বৈঠকে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, স্টেট ডিপার্টমেন্টের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, হোয়াইট হাউস এবং ইউএসএআইডি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।