বাজারে অস্থিরতা : আবারও বাড়লো সয়াবিন তেলের দাম
মনিটরিংয়ের ঘাটতি : হুহু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার
স্টাফ রিপোর্টার: বাজারে এ অস্থিরতার মধ্যেই ফের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন নতুন এ দাম নির্ধারণ করে শিগগিরই কার্যকরের ঘোষণা দিলেও গতকালই নতুন দাম কার্যকর করে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল সন্ধ্যায় প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৯৯ টাকায় ও ২ লিটারের বোতল ৩৯৮ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। ভোজ্য তেল আমদানিতে সরকারের দেয়া ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ৩০ এপ্রিল শেষ হয়ে যাওয়ায় এ দাম বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি বাজারে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবু বাড়ছে সব নিত্যপণ্যের দাম। বর্তমানে চালের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হলেও এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। বাজারে প্যাকেটজাত চিনি উধাও। গরম মসলার উত্তাপ দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে আরেক দফা বাড়লো সয়াবিন তেলের দাম। ৫০ টাকার নিচে নেই কোনো সবজি। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের অবস্থা ত্রাহি। এর থেকে পরিত্রাণের আপাতত কোনো উপায় কেউ বলতে পারছে না।
এ ব্যাপারে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, দ্রব্যমূল্যের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের আর্থিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জীবনযাত্রার মান রক্ষা করা কঠিন হয়ে গেছে। অনেকে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন ভোগ্যপণ্যের দাম কমতির দিকে। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি ঠিকভাবে কাজ করছে না। বাজার মনিটরিংয়ের ঘাটতিও রয়েছে।
ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত বছর আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছিলো। তবে এই ভ্যাট আর ছাড় দিতে চায় না সরকার। ফলে আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আবারো চালু করায় আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের সয়াবিন তেলের দাম। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম এক লাফে বেড়েছে লিটারে ১২ টাকা পর্যন্ত। নতুন দর অনুযায়ী ভোক্তাদের এখন বোতলজাত তেল কিনতে হবে প্রতিলিটার ১৯৯ টাকায়। এতদিন যা বিক্রি হয়েছে ১৮৭ টাকায়। আর ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহার করায় খুচরা বাজারে এই দর আরও বেড়ে ২০০ টাকার উপরে উঠতে পারে। ভোজ্য তেল আমদানি করতে সরকারকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। কিন্তু গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়। তাই দেশের বাজারে দাম সহনীয় রাখতে ২০২২ সালের মার্চ মাসে ভ্যাটের পরিমাণ ১০ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। প্রথমে তিন মাসের জন্য এই সুবিধা দেয়া হলেও পরে তা একাধিকবার বাড়ানো হয়।
সর্বশেষ রমজান মাসে এই সুবিধার মেয়াদ ঈদের সময় পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলো আমদানিকারকরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত প্রত্যাহারকৃত ভ্যাটের মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ায় ওই দিনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তেলের দাম বৃদ্ধির আবেদন করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর চার দিনের মাথায় গতকাল সয়াবিন ও পাম তেলের দাম আরেক দফা বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সংগঠনটি।
জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট এবং আমদানিকারকরা প্রত্যাশিত এলসি খুলতে না পারার কারণে অস্থিরতা চলছে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে। এ অস্থিরতার কারণেই কয়েক মাস ধরে হুহু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানের ছুটির পর প্রথম দিন থেকেই বাড়তে থাকে ভোগ্যপণ্যের দাম। গত ১০ দিনের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের দাম মণপ্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৫০ টাকা। বৃহস্পতিবার সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৪৫০ টাকা মণ। ৪ হাজার ৬৫০ টাকা মণের পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৯৫০ টাকা। ৪ হাজার ১০০ টাকা মণের চিনি বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৬০০ টাকা। ঈদুল আজহার প্রায় দুই মাস বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বাড়ছে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ থেকে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত। এক মাস আগে ধনে কেজি ১৩০ টাকা দরে বিক্রি হলেও গতকাল খাতুনগঞ্জে বিক্রি হয়েছে ১৯০ টাকা কেজি। এক মাস আগের ১১২ টাকা কেজি দরের হলুদ ১১৯ টাকায়, ৩৮০ টাকা কেজি দরের ভারতীয় শুকনা মরিচ ৩৯০ টাকায়, ৩৫০ টাকা কেজি দরের দেশি শুকনা মরিচ ৮২০ টাকায়, ১ হাজার ২৮০ টাকা কেজি দরের এলাচ ১ হাজার ৪৮০ টাকায়, ১ হাজার ২৮০ টাকার লবঙ্গ ১ হাজার ৩৫০ টাকায়, ৫৮০ টাকার গোলমরিচ ৬৩০ টাকায়, ৩১০ টাকা দরের দারচিনি ৩২০ টাকায়, ৩০ টাকা দরের পিঁয়াজ ৫৫ টাকায়, ১৪০ টাকার চীনা আদা ৩৭০ টাকায়, ১২০ টাকার রসুন ১৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডালের দাম কমেছে।
অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম মোল্লার সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভোজ্য তেল আমদানিতে সরকার প্রদত্ত ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ গত ৩০ এপ্রিল শেষ হওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে ভোজ্য তেলের নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। খোলা সয়াবিন লিটারপ্রতি ১৭৬ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন লিটারপ্রতি ১৯৯ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ৯৬০ টাকা, পাম সুপার খোলা সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৮৭ টাকা, খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিলো ১৬৭ টাকা। আর পাঁচ লিটার ২১ টাকা কমিয়ে ৯০৬ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম ছিলো ১১৭ টাকা। গত ১৫ই ডিসেম্বরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে ভোজ্য তেলের এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছিলো। সেই হিসাবে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১২ টাকা, খোলা তেলের দাম ৯ টাকা, পাঁচ লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৫৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। গত ১৭ই নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ১২ টাকা বাড়িয়ে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯২ টাকা, ৫ লিটারের দাম ৯২৫ টাকা, খোলা প্রতিলিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৭২ টাকা এবং প্রতিলিটার পাম অয়েলের দাম ১২১ টাকা নির্ধারণ করেছিলো। আগের হারে এখন ভ্যাট আদায় হবে বলে এক লিটার বোতলের সয়াবিন তেল ২০৫ টাকা, পাঁচ লিটার বোতলের সয়াবিন তেল এক হাজার ৫ টাকা, এক লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৮৪ টাকা এবং এক লিটার খোলা পাম তেল ১২৯ টাকা দরে বিক্রি করতে হবে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলছেন, প্রজ্ঞাপনটির মেয়াদ বাড়াতে এপ্রিলের শুরুর দিকেই এনবিআরকে চিঠি পাঠিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এনবিআর থেকে তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে প্রজ্ঞাপনটি উঠে গেলেও এখনই ভোজ্য তেলের দামের ওপর প্রভাব পড়ার কথা নয় বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মওলা বলেন, আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের এটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমদানিকারক কিংবা উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে আমরা তেল কিনে ব্যবসা করি। তারা যে দাম নির্ধারণ করে দিবে আমরা সেই দামে কিনে এনে বিক্রি করবো। তারা আমদানি করেন তারাই ভ্যাট প্রদান করবেন। তারাই দাম নির্ধারণ করবেন। সরকারও ভ্যাট ছাড় দেবে না। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তাদের কথা চিন্তা না করেই আবারো ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি করা হলো। প্রত্যাহারকৃত ভ্যাট চালু করা হলো, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে এখন ভোজ্য তেলের দাম যেহেতু স্থিতিশীল, এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দাম না বাড়ালে ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকতো। এখানে ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ব্যবসায়ীরা শুধু নিজেদের মুনাফা যাতে না কমে সেদিকেই লক্ষ্য করে দাম বাড়িয়েছেন।