বাবার বুকেই মারা গেলো ৫ বছরের বুলবুলি

ময়মনসিংহে দুর্ঘটনা : ছেলের মৃত্যুর ১১ ঘণ্টার মাথায় আরও ৮ স্বজনকে হারালেন বৃদ্ধা
স্টাফ রিপোর্টার: গত সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় ছেলেকে হারিয়েছেন মজিদা বেগম (৫৮)। ছেলের শোকে এখনো তার বুকফাটা আর্তনাদ, আহাজারি চলছে। ছেলের মৃত্যুর মাত্র ১১ ঘণ্টার মাথায় তিনি হারালেন ভাই, ভাবি, তিন বোন, নাতনিসহ আট স্বজনকে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে সাতটায় ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়লে মজিদা বেগমের আট স্বজনের মৃত্যু হয়। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বারমারি গ্রামের বাসিন্দা মজিদা বেগমের ছেলে আবুল হাসেমের (৩৮) জানাজায় অংশ নিতে গতকাল ভোরে মাইক্রোবাসে করে রওনা দিয়েছিলেন ওই স্বজনেরা।
ময়মনসিংহ-শেরপুর সড়কের ফুলপুর উপজেলার বঁশাটি এলাকায় যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুড়ে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এতে শিশু বুলবুলি আক্তার (৭) বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই মৃত্যুবরণ করে। মাইক্রোবাস রাস্তার পাশের পানিতে ডুবে গেলে নিজ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রক্ষার শেষ চেষ্টা করেন বাবা শাহজাহান। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আদরের মেয়েকে বুক থেকে ছাড়েননি এ বাবা। মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে বাবা কন্যাকে ছেড়ে যায়নি। নিজের শেষ শক্তিটুকুও ব্যয় করে চেয়েছিলেন কন্যাকে বাঁচিয়ে তুলতে। অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়া নিশ্চিত জেনে পরম মমত্ববোধে আগলে নিয়েছেন নিজের বুকে। বাবার বুকের মাঝেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মেয়েটি। পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় এই শিশু ও তার মায়ের। বাবা বেঁচে যান। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার টিম যখন তাদের পানি থেকে উদ্ধার করে তখনও মৃত মেয়েটি বাবার বুক জড়িয়ে ছিলেন। সন্তানের প্রতি একজন বাবার ভালোবাসা কতোটা তীব্র হতে পারে এটাই প্রমাণ করলেন শাহজাহান। একমাত্র বাবা ছাড়া এ ভালোবাসা কেউ কখনও অনুভব করতে পারবে না। নিজের সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটাও অনায়াসে করতে দ্বিধা নেই যেই মানুষটির তিনি বাবা। এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে উপস্থিত সকলের চোঁখে পানি চলে আসে। তাদের বাড়ি ভালুকা উপজেলার বাকশীবাড়ি বিরুনিয়ার গ্রামে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার বারমারি গ্রামসূত্রে জানা গেছে, গতকাল আবুল হাসেম রাত সাড়ে আটটার দিকে মা মজিদা বেগমের জন্য বারমারি বাজারে পান কিনতে যান। এসময় হঠাৎ তিনি সড়কে পড়ে যান। তার নাক-মুখ ফেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক হাসেমকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসক জানান, হৃদযন্ত্রের ক্রীয়া বন্ধ হয়ে হাসেমের মৃত্যু হয়েছে। হাসেমের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে স্বামীহারা মজিদা বেগম নিঃসন্তান হয়ে গেলেন। গত বছর স্বামী আবদুস সামাদ অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরপর ছোট ছেলে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মারা যান। আবুল হাসেমের স্ত্রী নাজমা বেগম ও ১২ বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। গ্রামবাসীসূত্রে জানা গেছে, আবুল হাসেমের মৃত্যুর খবর রাতেই ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ভালুকা উপজেলায় থাকা মজিদা বেগমের ভাই-বোনসহ স্বজনদের জানানো হয়। হাসেমের জানাজায় অংশ নিতে গতকাল ভোরে ভালুকায় স্বজনেরা মিলিত হয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে নালিতাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হন। এসময় ফুলপুরের ছনকান্দা ইউনিয়নের বাশাটি গ্রামে মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় নিহত হন মজিদা বেগমের ভাই শামছুল হক (৬৫), ভাবি রোজিনা খাতুন (৫৩), তিন বোন পারুল আক্তার (৫০), মোছা. বেগম (৩০) ও মিলুয়ারা বেগম (৫৫), মিলুয়ারা বেগমের নাতনি বুলবুলি আক্তার (৭) এবং দুই স্বজন রিপা খাতুন (৩০) ও নবী হোসেন (৩০)।
মারা যাওয়া হাসেমের চাচা সুলতান আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখনো হাসেমের মাকে তার ভাই-বোনসহ আটজনের নিহত হওয়ার খবরটি জানাইনি। তিনি হাসেমের মৃত্যুর শোকই সহ্য করতে পারছেন না। এর ওপর এতো স্বজন হারানোর খবর কীভাবে দেবো, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
ফুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমারত হোসেন জানান, মজিদা বেগমের স্বজনদের বহনকারী ওই মাইক্রোবাসে চালকসহ ১৩ জন যাত্রী ছিলেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে মাইক্রোবাস থেকে আটজনের লাশ উদ্ধার করেন। মাইক্রোবাস থেকে চারজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাদের ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। লাশগুলো উদ্ধার করার পর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More