মরসুমের শুরুতেই নিপায় চারজনের মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার: শীত মরসুমের শুরুতেই দেশে নিপা ভাইরাসের (নিপাহ) প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে রোগটিতে ৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে রোগটি প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। গত ২০ বছরে দেশে রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১৯ জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২২৫ জনের। বাংলাদেশে রোগটিতে মৃত্যুর গড় হার ৭০ দশমিক ৫৩ জন। দেশের করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে নিপার প্রাদুর্ভাবকে আশঙ্কাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, নিপা একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। কিন্তু কোভিডের মতো এ ভাইরাস হাঁচি-কাশি বা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। এটি একটি বাহকবাহিত সংক্রামক রোগ। মূলত বাদুড়ের মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে থাকে। তাই সচেতনতার মাধ্যমে সহজেই রোগটি থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
এ বিষয়ে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিডিআর) সাবেক পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রোগতত্ত্ববিদ ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, নিপাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুহার ৭৭ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগটিকে ‘পেন্ডেমিক প্রটেনশিয়াল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ এ রোগটি বিশ্বে মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। এ রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। তবে সেটি কবে পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু রোগটির নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই তাই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে। কাঁচা খেজুর রস, তালের রস এবং কাঁচা ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
চিকিৎসকরা জানান, নিপা একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এ ভাইরাসের প্রধান বাহক হচ্ছে বাদুড়। ফলে খেজুরের রসে বাদুড় মুখ দিলে হাঁড়ির মধ্যে বাদুড়ের লালার মাধ্যমে প্রবেশ করে ভাইরাসটি। সেই রস কাঁচা অবস্থায় পান করলে মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। একইভাবে তালের রস, পেয়ারা, লিচু জাতীয় ফল থেকেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। এছাড়া আক্রান্ত মানুষ থেকেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। আমাদের দেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমে জ্বর হয়। তারপর শুরু হয় মাথাব্যথা ও ক্লান্তি। এছাড়া শ্বাসজনিত সমস্যাও দেখা দেয়। মূলত এ ভাইরাসটি মস্তিষ্কে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করে। নিপার মতো একাধিক ভাইরাসের কারণে এনকেফালাইটিস বা মস্তিষ্কের প্রদাহ হয়। এনকেফালাইটিসে তীব্র জ্বর, মাথাব্যথার পাশাপাশি ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যায়। বমি ভাব হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি আলোক সংবেদনশীলতা সৃষ্টি হয়। সংক্রমনের তীব্রতা বাড়লে হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় রোগী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোমায় চলে যেতে পারেন। বেশরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। যারা বেঁচে থাকেন তাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
মানুষের মধ্যে নিপাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায়। এরপর ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে। দুই দেশে তখন ২৭৬ জনের মৃত্যু হয়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইন এ ৫টি দেশে এ রোগের সংক্রমণ দেখা গেছে।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ সালে এ রোগটি প্রথম ধরা পড়ে। ওই বছর রোগটিতে ১৩ জন আক্রান্ত হন এবং ৯ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২০০৪ সালে ৬৭ জন আক্রান্ত হন এবং ৫০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৫-এ আক্রান্ত ১৩ মৃত্যু ১১; ২০০৭-এ আক্রান্ত ১৮ মৃত্যু ৯; ২০০৮-এ আক্রান্ত ১১ মৃত্যু ৯; ২০০৯-এ ৪ জন আক্রান্ত হলেও কোনো মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১০-এ আক্রান্ত হন ১৮ জন মৃত্যু হয় ১৬ জনের। অর্থাৎ এ বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হার ৮৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এরপর ২০১১ সাল থেকে যথাক্রমে আক্রান্ত ৪২ মৃত্যু ৩৬; ২০১২ সালে আক্রান্ত ১৮ মৃত্যু ১৩; ২০১৩ সালে আক্রান্ত ২৬ মৃত্যু ২২; ২০১৪ সালে আক্রান্ত ৩৮ মৃত্যু ১৫; ২০১৫ সালে আক্রান্ত ১৮ মৃত্যু ১১; ২০১৭ সালে আক্রান্ত ৩ মৃত্যু ২; ২০১৮ সালে আক্রান্ত ৪, মৃত্যু ৩; ২০১৯ সালে আক্রান্ত ৮ মৃত্যু ৭ এবং চলতি বছর এরই মধ্যে আক্রান্ত ৬ মৃত্যু ৪ জন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More