সর্বোচ্চ সতর্কতা ই-কমার্সে : প্রতারণা করা সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

রাসেল ও তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদে নানা তথ্য : ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে বন্ধ ইভ্যালির অফিস
স্টাফ রিপোর্টার: বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। শুরুর দিকে অসুস্থতার কৌশলে কাজ না হওয়ায় রাসেল অবশেষে তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে গতকাল দুপুর থেকে এই দম্পতিকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে ইভ্যালির মতো গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করা অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘মামলার এজাহারে বাদী আরিফ বাকের যে অভিযোগ করেছেন সে অনুযায়ী রাসেল ও তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এগুলো তদন্ত করে দেখছি। যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।’ একাধিকসূত্রে জানা গেছে, ইভ্যালিকে ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তরুণদের টার্গেট করেছিলেন রাসেল। কারণ অনলাইন প্ল্যাটফরমে চমকপ্রদ অফারের বিজ্ঞাপন দেখলেই লুফে নিত তরুণরা। এভাবে অফারের ফাঁদে বিপুলসংখ্যক তরুণ বিনিয়োগ করতে থাকায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রাসেল। আর তার এই অপকর্মের মূলে কলকাঠি নেড়েছেন স্ত্রী শামীমা। ইভ্যালির অফিসেও ছিল রাসেলের স্ত্রীর আত্মীয় ও বন্ধুদের আধিপত্য। ইভ্যালির শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাসেল প্রকাশ্যে থাকলেও কোম্পানির প্রায় সব ধরনের কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণ ছিল শামীমা এবং তার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের হাতে। কোম্পানির হেড অব এইচআর ছিলেন রাসেলের শ্যালিকা সাবরিনা নাসরিন। ডিরেক্টর টেকনিক্যাল শামীমার বোনের স্বামী মামুনুর রশীদ। ডিরেক্টর পারচেজ অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট শামীমার বন্ধু আতিকুর রহমান। আর তার দুই ভাগ্নে জাহেদ ও জুবায়ের দেখতেন মোটরসাইকেলের বিষয়গুলো। তবে কোম্পানীকে সঠিক পথে চালিয়ে নিতে জবাবদিহি এবং সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগের অভাব ছিল বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আদালতের নির্দেশে ইভ্যালির এমডি রাসেল ও তার স্ত্রীর রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ার পর আমরা দুটি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। প্রথমত, যে মামলাটি হয়েছে সেখানে ভুক্তভোগীর সঙ্গে কীভাবে প্রতারণা করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, লাখ লাখ গ্রাহকের যে বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাতের কথা শোনা যাচ্ছে, সেই টাকা কোথায় আছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের অংশ হিসেবে শুক্রবার রাতে রাসেলের কাছে কিছু প্রশ্ন জানতে চাওয়া হয়েছিল। তখন তিনি হঠাৎই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং বুকে ব্যথা অনুভব করছেন বলে জানান। তখন তাকে হাসপাতালে পাঠানোয় বেশ খানিকটা সময় অপচয় হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে রাসেল ও তার স্ত্রীর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তারা দুজনই স্বাভাবিকভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন।’ রিমান্ডে পাওয়া সব তথ্য আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান এসআই ওয়াহিদুল। এদিকে এমডি রাসেলের মুক্তির দাবিতে আবারও মানববন্ধন করেছেন ইভ্যালির গ্রাহক ও সেলাররা। গতকাল বিকালে ধানমন্ডিতে ইভ্যালি অফিসের সামনে দুই শতাধিক গ্রাহক ও সেলার এ মানববন্ধন করেন। এ সময় তারা রাসেলের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। মানববন্ধনে আমজাদ হোসেন আকাশ নামে এক সেলার বলেন, রাসেলকে আটকে রাখলে কখনই সমস্যার সমাধান হবে না। যেহেতু তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে দেশ ত্যাগের সযোগ নেই। সুতরাং তাকে মুক্তি দিয়ে নজরদারিতে রেখে পাওনাদারদের টাকা ফেরত দেওয়ার সুযোগ প্রদান করা হোক।
এমডি রাসেল ও তার স্ত্রী গ্রেফতারের পর হাজার হাজার পাওনাদারের উৎকণ্ঠার মধ্যে ইভ্যালির অফিস আবার বন্ধ হলো। প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এখন বাসায় থেকে অফিসের কাজ করবেন বলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পাতায় ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে ইভ্যালি বলেছে, হোম অফিসের মধ্যেও তাদের সব কার্যক্রম ‘স্বাভাবিক’ সময়ের মতো চলবে। গতকাল ইভ্যালির ফেসবুক পাতায় বলা হয়, ‘পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ইভ্যালি এমপ্লয়ীরা নিজ নিজ বাসা থেকে অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। হোম অফিস পদ্ধতিতে ইভ্যালির সব কাজ স্বাভাবিক নিয়মে চলমান থাকবে। আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা আমাদের একান্তভাবে কাম্য।’
এর আগে শুক্রবার দিবাগত রাত ২টায় ‘টি-১০’ সংক্রান্ত এক ‘জরুরি নোটিসে’ ইভ্যালির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের প্রধান দুজন সিগনেটরি-সম্মানিত সিইও এবং চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে আমাদের সেলারদের রেগুলার বিল দিতে পারছি না। এজন্য আমাদের স্বাভাবিক ডেলিভারি কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। তাই আপনাদের (ক্রেতা) করা শুক্রবারের টি-১০-এর সব অর্ডার আপাতত রিকোয়েস্ট হিসেবে জমা থাকবে।’
আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের নামে এবার যশোরে মামলা করেছেন এক গ্রাহক। শুক্রবার জাহাঙ্গীর আলম চঞ্চল নামে এক ব্যক্তি কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। গতকাল সকালে কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলায় জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেন, ২৯ মে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৪০ টাকায় ভারতীয় বাজাজ কোম্পানির একটি পালসার মোটরসাইকেলের অর্ডার করেন তিনি। এরপর কয়েকটি কিস্তিতে পুরো টাকা পরিশোধও করেন। টাকা পরিশোধের ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। সাড়ে তিন মাসেও মোটরসাইকেল পাননি তিনি।
ইভ্যালির মতো গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করা অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ডিবির প্রধান একেএম হাফিজ আক্তার। গতকাল দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে তিনি বলেন, ‘ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জসহ এমন আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা প্রতারণা করেছে। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রির অফার দিয়ে যারা গ্রাহকদের পণ্য দেয় না, তারা মূলত প্রতারণা করছে। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতারকদের বেশি বেশি ধরা হলে ধীরে ধীরে প্রতারণা কমে আসবে।
পণ্য সরবরাহ বাবদ প্রায় ২০০ কোটি টাকা ফেরত দিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ধামাকা শপিং ডটকমের কর্তৃপক্ষকে পাঁচ দিন সময় বেঁধে দিয়েছেন বিক্রেতারা। এর মধ্যে কোনো পদক্ষেপ না নিলে ধামাকার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি তারা ধামাকা শপিং ডটকমের সঙ্গে লেনদেন বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতার সুষ্ঠু সমাধানের দাবি জানিয়েছেন। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় বিক্রেতাদের সংগঠন ধামাকা শপিং ডটকম সেলার অ্যাসোসিয়েশন। লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, মাইক্রোটেড গ্রুপের আওতাধীন ইনভ্যারিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড পরিচালিত ধামাকা শপিং ডটকমে প্রায় ৬৫০ জন সেলার বা মার্চেন্ট হিসেবে তারা পণ্য বিনিয়োগ করেছেন। প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সেলাররা পাননি।
প্রসঙ্গত, বুধবার দিবাগত রাতে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে মো. রাসেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা (নম্বর-১৯) দায়ের করেন আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির একজন গ্রাহক। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে মোহাম্মদপুরের নিলয় কমপ্রিহেনসিভ হোল্ডিংয়ের বাসায় (হাউস ৫/৫এ, স্যার সৈয়দ রোড) অভিযান চালিয়ে ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। পরে গুলশান থানার ওই মামলায় শুক্রবার তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে গুলশান থানা পুলিশ। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More