সারাদেশে লোডশেডিং : লাগাম টানার বড় চ্যালেঞ্জে সরকার

মুক্তি মিলবে কবে, বলতে পারছে না কেউ : ৮টার পর দোকান খোলা রাখলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন

স্টাফ রিপোর্টার: অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে দেশে এলাকাভিত্তিক এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং ও রাত ৮টার পর দোকানপাট, শপিং মল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অফিস-আদালত ও বাসাবাড়ির এয়ার কন্ডিশনের (এসি) তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রির ওপরে রাখতে এবং মসজিদে নামাজের সময় ছাড়া এসি না চালানোসহ মোট ৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদিকে, সপ্তাহে এক দিন পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখার বিষয়ে যে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে তাও কাজে লাগবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে এ ছক কষা হলেও বাস্তবে এ লাগাম টেনে ধরা সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও অতীত অভিজ্ঞতা পর্যালোচনায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা এমনটাই মনে করছেন।

তাদের আশঙ্কা, করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার একগাদা নির্দেশনা দেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে জনগণের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে যে ধরনের দুর্বলতা ছিলো, এবারের কৃচ্ছতা সাধনের ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতির সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। যা এ উদ্যোগ সফল হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কয়েকটির চাবি সরকারের হাতে থাকলেও বাকিগুলো দেশের মানুষের সহায়তা ছাড়া বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব।

অর্থনীতিবিদরা জানান, করোনা মহামারি আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেই টালমাটাল অবস্থা চলছে। দেশে দেশে জ্বালানির সংকট, মুদ্রাস্ফীতি আর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতেও এসব সংকটের নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক দিকে ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন, আরেক দিকে ব্যাপক মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে ব্যয় সংকোচনের নীতি গ্রহণ করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোন পথে এই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং ব্যয় সংকোচনের নীতি সফল করে তোলা সম্ভব হবে এখন পর্যন্ত তার যথাযথ পথনির্দেশনা দেখা যায়নি।

সদ্য শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর এক ধরনের স্বীকৃতি থাকলেও এসব সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সমন্বিত মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি অনুপস্থিত। অন্য দিকে বাজেটের সঙ্গে আয়-ব্যয়ের কাঠামোতে সঙ্গতিপূর্ণ পরিবর্তন নেই, আয় কাঠামোতে যা-ও আছে, ব্যয় কাঠামোতে তা-ও নেই।

বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু সরকারি হিসাবেই বর্তমান ৬ দশমিক ৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে কীভাবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা যাবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পথরেখা নেই। বিলাসদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করে কিছুটা ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে অতি জরুরি নয় এ ধরনের পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরার পরিকল্পনাও আশানুরূপভাবে সফল হয়নি। বরং পণ্য আমদানির উল্লস্ফনে এর বিপরীত চিত্র ধরা পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৪ জুলাই প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থ বছরের প্রথম ১১ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮১ কোটি ডলার। আলোচিত সময়ে রপ্তানি থেকে দেশ আয় করেছে ৪ হাজার ৪৫৮ কোটি ডলার। আর পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় করেছে ৭ হাজার ৫৪০ কোটি ডলার। একই সময়ে সেবা খাতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৩৪ কোটি ডলার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, লাগামহীন আমদানিতে বেশ চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি ভারসাম্যের বড় ঘাটতি (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) দেখা দিয়েছে। এতে ডলারের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ডলার বাজারে ছাড়া হলেও আমদানি বাড়ায় চাহিদা মিটছে না।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অনেক দিন থেকেই আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানার কথা বলে আসছিলাম। সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু দেরিতে। সে কারণেই ডলারের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।’ এ পরিস্থিতিতে আমদানি কমিয়ে ডলারের ঘাটতির লাগাম টেনে ধরা সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই পণ্য আমদানির এলসি খুলতে এমন উল্লম্ফন দেখা যায়নি। আর এতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও চাপের মধ্যে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বেশ কিছু দিন ধরেই আমদানির লাগাম টানার পরামর্শ দিচ্ছিলেন অর্থনীতিবিদরা। অস্বাভাবিক এই আমদানির লাগাম টেনে ধরতে বিলাস পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত এলসি মার্জিন আরোপসহ নানা পদক্ষেপ নেয় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২৪ মে এনবিআরের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ১৩৫টি এইচএস কোডেড পণ্য যেমন বিদেশি ফল, ফুল, আসবাবপত্র ও প্রসাধনী সামগ্রীর ওপর ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। যা ৩০ মে থেকে কার্যকর করা হয়। সংশ্লিষ্টরা আশা করেন, এই পদক্ষেপটি বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ হ্রাস করবে। তবে বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। বরং দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আমদানির লাগাম টানতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপেও কাজ হচ্ছে না।

জানা গেছে, এর আগে গত ১০ মে আরেকটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, সব ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপস্নায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। একইসঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সাধারণের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।

একইসঙ্গে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানতে ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নেয় সরকার। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানি নির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয় সরকার। কিন্তু এসব উদ্যোগ কোনোটাই তেমন কাজে লাগেনি।

এদিকে দেশে ডলার সংকট নিরসনে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে সরকার নানাভাবে কৃচ্ছ সাধনের চেষ্টা চালালেও এরই মধ্যে ফাঁকফোকর গলিয়ে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের নামের বিদেশ সফরের আয়োজন হচ্ছে কমবেশি।

অতি সম্প্রতি ‘ইলেকট্রনিক ডাটাসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি (ইপিসিবিসিএসপি) প্রকল্পে ৫০ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফরের প্রস্তাব করা হয়েছে। জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং দেখতে যাওয়া এ সফরের জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এ হিসেবে প্রত্যেকের পেছনে প্রায় ৪ লাখ টাকা করে ব্যয় হবে। অথচ এটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব। এর আগে মূল অনুমোদন এবং প্রথম সংশোধনীতে বিদেশ সফরের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না।

বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে রীতিমতো রেকর্ড সৃষ্টি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত নভেম্বর থেকে চলতি ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৭৭টি জিও হয়েছে। এই জিওর অনুকূলে ৩৩২ জনের বিদেশ সফরের অর্ডার হয়েছে। এর মধ্যে দেশে ডলার সংকট দেখা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মে বিদেশ সফর বন্ধে অর্থ বিভাগ থেকে সার্কুলার জারির পরও ৩০টি জিও হয়। যার অনুকূলে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পান ১১৪ জন। সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীদের নামও রয়েছে এই তালিকায়।

এদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে ১৯ জুলাই থেকে সরকার সারা দেশে এক ঘণ্টা লোডশেডিংসহ যে ৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছে তা বাস্তবায়ন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর ম. তামিম বলেন, ‘সারা দেশে দিন-রাত মিলিয়ে এক ঘণ্টা লোডশেডিং এবং রাত ৮টার পর দোকানপাট, শপিং মল, মার্কেট ও বিপণি বিতান বন্ধ রাখার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে না। কারণ সরকারের হাতে তা নিয়ন্ত্রণের পুরো সুযোগ রয়েছে। একইভাবে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখতে পারবে। কিন্তু এসির তাপমাত্রা- যেটি বলা হয়েছে ২৫ ডিগ্রিতে রাখার কথা, জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা, অযথা ঘোরাঘুরি না করা, গাড়ি কম ব্যবহারের কথা অর্থাৎ মানুষের সহায়তা যে বিষয়গুলোতে আছে, সেগুলো জনগণের সাপোর্ট ছাড়া সরকারের পক্ষে ইমপিস্নমেন্ট করা সম্ভব না। জনগণ যদি কৃচ্ছতা সাধনে সরকারকে যথাযথভাবে সহায়তা করি তাতে হয়তো লোডশেডিং একসময় কমে আসবে।

এদিকে দৈনিক এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলেও জ্বালানি খরচ বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি, ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা শহরের মাঝারি বড় ফ্ল্যাটগুলোতে ডিজেল- পেট্রোলচালিত জেনারেটর রয়েছে। অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, ছোট বড় কল-কারখানাতেও জেনারেটর ব্যবহৃত হচ্ছে। সারা দেশে সিডিউল লোডশেডিংয়ে জেনারেটরের ব্যবহার কয়েকগুণ বাড়বে। এতে বিপুল পরিমাণ ডিজেল-পেট্রোল পুড়বে।

অন্য দিকে সপ্তাহে এক দিন পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখায় ‘বায়িং প্যানিক’ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, আতঙ্কিত ক্রেতাদের অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জ্বালানি কিনে মজুদ রাখবে। প্রাইভেটকার ও গণপরিবহণ মালিক-চালকরা পেট্রোলপাম্প বন্ধের আগের দিন এক সঙ্গে অন্তত দুই দিনের পেট্রোল-ডিজেল কিনবে। এতে জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্যোগ অনেকটাই ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More