সীমাহীন অনিয়মে বাতিল গাইবান্ধার উপনির্বাচন

সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথম : অসহায়ত্ব প্রকাশ সিইসির

স্টাফ রিপোর্টার: গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের সুস্পষ্ট ঘটনায় গতকাল ভোটগ্রহণ বাতিল করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর আগে ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, এজেন্টদের বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট ও ইভিএমে জালিয়াতির নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন নৌকা ব্যতীত অন্য চার প্রার্থী।

এদিকে ভোটকক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কারচুপির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার কথা জানিয়েছেন স্বয়ং সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। অবশ্য নিকট অতীতে অনিয়মের কারণে কোনো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে আগে কোনো কমিশনকে দেখা যায়নি।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনের উপনির্বাচনে ভোটারদের বাধা, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া এবং গোলযোগ সৃষ্টির কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ভোট গ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করেছেন সিইসি। এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টায় আওয়ামী লীগ ব্যতীত জাতীয় পার্টির এএইচএম গোলাম শহীদ রঞ্জু (লাঙল), বিকল্পধারার জাহাঙ্গীর আলম (কুলা), স্বতন্ত্র প্রার্থী নাহিদুজ্জামান নিশাদ (আপেল) ও স্বতন্ত্র সৈয়দ মাহবুবুর রহমান (ট্রাক) ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। ভোটের পরিস্থিতি দেখে ওই চার প্রার্থী সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা স্কুল ভোটকেন্দ্রে সাংবাদিকদের কাছে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি জানান। আসনটিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে প্রার্থী ছিলেন মাহমুদ হাসান রিপন।

নৌকা প্রার্থী ছাড়া বর্জনকারী জাতীয় পার্টি সমর্থিত প্রার্থী ও জাপা কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এএইচএম গোলাম শহীদ রঞ্জুসহ সাঘাটা উপজেলার বগারভিটা স্কুলকেন্দ্রে চার প্রার্থী একত্র হয়ে সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আ’লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট দেয়া, ইভিএমে জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরেন।

গাইবান্ধা জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্মআহ্বায়ক শাহজাহান খান আবু জানান, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতাকর্মীরা সিসি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে কেন্দ্র তাদের দখলে নেয়। এছাড়া ভোটকেন্দ্র থেকে জাতীয় পার্টির এজেন্টদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনের গাফেলতির কারণে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই সুযোগ নিয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ ঘটনার জন্য নির্বাচন কর্মকর্তারাও দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসার ও রাজশাহী আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেখানে আমার কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, বেলা ১০টা পর্যন্ত অনেক কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে ভোটারদের উপস্থিতি নেই। কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি থাকলেও তিন-চারজনের বেশি লক্ষ্য করা যায়নি। এ সময় প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে।

ভোটচুরি স্বচক্ষে দেখেছি: প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এ বিষয়ে বলেছেন, গাইবান্ধার উপনির্বাচনে ভোটকক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের ভোট কারচুপি আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তাই পুরো ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। গতকাল নির্বাচন ভবনে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন। সিইসি বলেন, সকালে ভোট শুরু হয়। নির্বাচন ভবনে সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। আমরা বসে ভোট পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি- ভোট গ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে এবং অনেক কক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছি। অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট প্রদানে সহায়তা বা বাধ্য করছে- এটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য করেছি, যেটি নিয়ম নয়। তারপরেও আমরা দেখেছি-পোলিং এজেন্ট সম্ভবত তাদের অনেকের গায়ে যে পোশাক সেখানে প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি, ওড়না ছিল যেটা নির্বাচন আচরণবিধির পরিপন্থী। তিনি বলেন, আমাদের সহকর্মীরা সকাল ৮টা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখেছি; কেউ কক্ষ ত্যাগ করেননি। এটা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং অনিয়মগুলো বা ম্যাল প্র্যাকটিসেসগুলো মোটা দাগে হচ্ছিল। যার ফলে আমরা উপস্থিত থেকে প্রথমে তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছি। এরপরে ১৬টি কেন্দ্রে, তৃতীয় দফায় ১২টি; চতুর্থ দফায় ৯টি এবং সব শেষ আরো তিনটি; মোট ৪৩টি ভোট কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দিয়ে সাড়ে ১২টায় কক্ষ ত্যাগ করি।

সিইসি আরো বলেন, আমরা দেখেছি কতগুলো কেন্দ্রে সিসিটিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। যার ফলে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। সব মিলিয়ে মোট ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেছি। রিটার্নিং অফিসারও একটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেন। এরপর আমরা কমিশনের সব সদস্য মিলে বিষয়টি পর্যালোচনা করতে থাকি, বিশ্লেষণ করতে থাকি। এ পর্যায়ে আমাদের আরপিও ৯১ই ধারা অনুযায়ী কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়, ভোট সঠিকভাবে হচ্ছে না। আমরা নিশ্চিত হই, ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ, ফলাফল- সব বিবেচনা করলেও আসলে সঠিক মূল্যায়নটা হবে না।

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমাদের কাছে মনে হয়েছে ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একটি পক্ষ বা একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছে। আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে-সুষ্ঠু নির্বাচন গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা ৫১টি ভোটকেন্দ্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আইনকানুন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম-গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ অনুচ্ছেদে যে দায়িত্ব ইসিকে দেয়া হয়েছে, ইসির কাছে এটা প্রতীয়মান হয় নির্বাচন সঠিকভাবে হচ্ছে না। আমরা পরিশেষে পুরো নির্বাচন গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি। পরে বিধিবিধান অনুযায়ী কী করতে হবে দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব।

গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত। উপনির্বাচনে সাঘাটা উপজেলায় ৮৮টি এবং ফুলছড়ি উপজেলায় ৫৭টিসহ মোট ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে ভোটগ্রহণ হচ্ছিল।

অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া গত ২২ জুলাই রাত ২টায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ কারণে তার আসনটি শূন্য হয়।

বিবিসির পর্যবেক্ষণ: সকাল থেকে শুরু হওয়া এই নির্বাচনে অনিয়মের কারণে একের পর এক কেন্দ্রে ভোট বাতিল করা হয়। একপর্যায়ে দেখা যায় যত ভোটকেন্দ্র আছে সেখানে তার এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রেই ভোট বাতিল করতে হয়েছে। এসব ভোটকেন্দ্রে ভোট দেয়ার গোপন কক্ষে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।

কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন প্রথম থেকেই বলে আসছিল আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে তারা ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে চায়। তাদের বক্তব্য ভালো নির্বাচন করার এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ। বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক আপত্তি সত্ত্বেও আগামী নির্বাচন ইভিএমে করার ব্যাপারেই এখন পর্যন্ত অনঢ় আছে কমিশন। গতকালের ভোটগ্রহণও ইভিএমেই হচ্ছিল। কিন্তু তারপরও অনিয়মের অভিযোগে সেই ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিতে হলো।

বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা অনেক বছর ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনগুলোতে অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু নিকট অতীতে অনিয়মের কারণে দেশটিতে কোনো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেশটির কোনো নির্বাচন কমিশনকে দেখা যায়নি।

গতকাল বুধবারের নির্বাচন বন্ধ করা নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে অনিয়ম হচ্ছিল আমরা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছি। ‘কাদের কারণে ভোটটা বন্ধটা বন্ধ করতে হলো সে ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি, এটা এখন বলা যাবে না, এটা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।’ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, কেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যারা অনিয়ম করেছে তারা ভোট ডাকাত, দুর্বৃত্ত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

যেভাবে অনিয়ম: ফুলছড়ির একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তার কেন্দ্রে তেইশশো ভোটার রয়েছেন। কিন্তু বেলা দেড়টা পর্যন্ত ৫৪০টি ভোট গ্রহণ হয়েছে। তিনি বলেন, সকাল ১০টার পর থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন, তাদের সাথে পুলিশ ছিল। তারা এসে অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেন। এ দিকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

জাতীয় নির্বাচনের জন্য শিক্ষণীয়: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি মাত্র আসনে সুষ্ঠু ভোট সম্পন্ন করতে না পারাটা নির্বাচন কমিশনের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয় হবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, প্রথমত. ইলেকশন কমিশন একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে যে তারা নির্বাচনটা বাতিল করে দিয়েছে। তবে অনেক প্রশ্ন তিনি তুলেছেন- যেমন, যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের কতজন দায়িত্ব স্খলন করেছেন। তিনি বলেন, ‘ওনারা বলছেন- সিসিটিভিতে দেখেছেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে তড়িৎ গতিতে অ্যাকশন নিতে হবে। মানুষকে সেটা জানাতে হবে, যাতে মানুষের আস্থা ফিরে আসে নির্বাচন কমিশনের ওপর।’ তিনি বলেন, ‘এটা ইভিএমে সমস্যা না। এই একটি আসনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে সব আসনে সিসিটিভি লাগাতে পারবেন কি না জানি না। যদি না পারেন তাহলে বিকল্প কী হবে সেটাকে একটা শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে দেখা উচিত।’

আ.লীগের বিক্ষোভ, সিইসির পদত্যাগ দাবি : গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ বন্ধের প্রতিবাদে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা। গতকাল বুধবার বিকেলে ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদ চত্বরে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পদত্যাগ ও বিচার দাবি করেন তারা।

ফুলছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম সেলিম পারভেজ, গোলাম শহীদ রঞ্জু, শহিদুল ইসলাম বক্তব্য রাখেন। বক্তারা বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিএনপি-জাতীয় পার্টির এজেন্ডা হিসেবে কাজ করে নির্বাচন স্থগিত করেছে।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহমুদ হাসান রিপন সাঘাটা উপজেলা দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোট বন্ধের প্রতিবাদ জানান।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More