সুফল মিলছে না বাজারে : দামের কারসাজি বন্ধে মাঠে প্রশাসন

তদারকিতে সরকারের ১৪ সংস্থা : কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা-বাণিজ্যমন্ত্রী

স্টাফ রিপোর্টার: আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাজারে বাড়ানো হয়েছে পণ্যের জোগান। আমদানি ও মজুত পরিস্থিতিও চাহিদার চেয়ে বেশি। তারপরও কিছু পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে পণ্যের দাম আসছে না নিয়ন্ত্রণে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের তরফ থেকে নীতি সহয়তায় ছাড় দেয়া হয়েছে। বাজার তদারকিতে মাঠে কাজ করছে সরকারি ১৪টি সংস্থা। তারা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন। অনিয়ম পেলেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কারসাজির দায়ে কয়েকটি কোম্পানির কর্মকর্তাদের তলব করার ঘটনাও ঘটেছে। এতসব উদ্যোগের পরও সুফল মিলছে না বাজারে। ফলে এবারও পণ্যের বাড়তি দামেই শুরু হচ্ছে রমজান।

আজ শনিবার চাঁদ দেখা গেলে রোববার থেকে শুরু হবে রোজা। চাঁদ দেখা না গেলে রমজান শুরু হবে পরশু সোমবার থেকে। সে হিসাবে ভোক্তাদের রোজার বাজারের একটি বড় অংশই শুক্রবার ও শনিবারের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ফলে এই দুদিন বাজারে রোজানির্ভর পণ্য কেনার চাপ থাকবে। এদিকে কিছু পণ্যের দাম বাড়ায় লাগাম পড়েছে। এর মধ্যে সয়াবিন তেলের দাম নতুন করে আর বাড়ছে না। তবে সরকারিভাবে বেঁধে দেয়া দামেও বিক্রি হচ্ছে না। এক মাস আগে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে প্রতি লিটার ২০৫ টাকায় উঠেছিলো। এরপর তা কমে ১৭০ টাকায় নামে। সয়াবিন তেল আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের পর এর দাম কমিয়ে সরকার থেকে বোতলজাত তেলের দাম প্রতি লিটারে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই দামে নয়, এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬৫-১৭০ টাকা দরে। সরিষার তেলের চাহিদাও বাড়ে রোজায়। এক মাস আগে প্রতি লিটার বোতলজাত সরিষার তেল ছিলো ২৯০ টাকা। এখন তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকা।

রোজায় পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে সরকার এক মাস আগে থেকেই কাজ শুরু করে। কিন্তু করোনার পর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও সর্বশেষ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম এক জায়গায় থাকছে না। এ অবস্থায় রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাজার তদারকিতেও সরকারের ১৪ সংস্থা মাঠে কাজ করছে। ‘দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও প‚র্বাভাস সেল’ এটা মনিটর করছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২৮টি মনিটরিং টিম বাজার দাম পর্যবেক্ষণ করছে। টিসিবির তরফ থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে তিন হাজার ডিলারের মাধ্যমে নায্যম‚ল্যে ট্রাকসেল চলমান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমš^য়ে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে উচ্চপর্যায়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর থেকে সয়াবিন তেল পরিশোধন কাজে নিয়োজিত কয়েকটি কোম্পানিকে তাদের প্রধান কার্যালয়ে তলব করে শুনানি নেয়া হচ্ছে। এতকিছুর পরও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরকারের উদ্যোগের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কারসাজির মাধ্যমে পণ্যের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছেন।

এদিকে কাঁচাবাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদরে সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, এদিন প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮৫ টাকা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকা। ছোট দানা মসুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা, যা ১ মাস আগে ১২০ টাকা ছিল। অ্যাংকর ডাল বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৮২ টাকা। এক মাস আগে দাম ছিলো ৮০ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬৫-১৭০ টাকা। বিছুদিন আগেও ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা। যা এক মাস আগে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি খাসির মাংস বিক্রি হয়েছে ৯৫০ টাকা। আগে ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭০-১৮০ টাকা। যা এক মাস আগের দাম ১৬০ টাকা। প্রতি কেজি আমদানি করা রসুন ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১১০ টাকা। দেশি শুকনা মরিচ বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা। যা এক মাস আগে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

স¤প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিজে) জরিপে দেখা যায়, মূল্যবৃদ্ধি ও আয় কমায় সংকটে আছে অনেক পরিবার। ফলে স্বল্প আয়ের অনেকে ঋণ করে পরিবারে জন্য খাদ্যের জোগান অব্যাহত রাখছেন। এসব ঋণ নেয়া হচ্ছে মহাজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব থেকে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সিপিজের গবেষণা সহযোগী নাহিদা আক্তার বলেছেন-ঋণ নেয়ার হার কমেছে। তার মানে এ নয় যে মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়ে গেছে। অনেকে আগের ঋণ শোধ করতে পারেননি। তাই নতুন করে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন।

সূত্র জানায়, রোজায় পণ্যম‚ল্য সহনীয় রাখতে কৃষি বিপণন অধিদফতর ৪০টি পণ্যের যৌক্তিক ম‚ল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। ওই দামে পণ্য বিক্রি করতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছিলো অধিদফতর। এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে শাস্তির আওতায় আনার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। অধিদফতর থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি।

এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি স¤প্রতি বলেছেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেমন চাল, ডাল, তেল, ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন ও আদাসহ সব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। মজুতের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় বেশি। কোনো পণ্যের ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কৃত্রিম উপায়ে কোনো পণ্যের সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।

ক্যাবের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, করোনাকালীন যখন লকডাউন ছিলো, তখন কিন্তু পণ্যের দাম বাড়েনি। পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগিতা করে দাম বাড়ানো হয়েছে। রোজা উপলক্ষে আরেক দফা ম‚ল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ভোক্তা সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বাজার ও দোকানে ম‚ল্য তালিকা থাকার কথা। বাজার তদারকি যারা করছেন তারা প্রতিবারই জরিমানা করছেন। অল্প কিছু টাকা (পাঁচ থেকে ১০ হাজার) জরিমানা করা হচ্ছে। জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দৃষ্টান্তম‚লক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ম‚ল্য আরও বেড়ে যাবে।

এদিকে প্রতি কেজি মুড়ি বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা, যা এক মাস আগে ৬৫-৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি মাঝারিমানের খেজুর বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা। যা এক মাস আগে ৪৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মান ও বাজারভেদে প্রতি কেজি বেসন বিক্রি হয়েছে ৭০-১০০ টাকা। যা এক মাস আগে ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি বুটের ডাল ৬০-৭০ টাকা। যা এক মাস আগে ছিল ৫০-৬০ টাকা। এ দিন প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ২০-২২ টাকা। যা এক মাস আগে ১৮-২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি আঁটি ধনেপাতা ও পুদিনা পাতা বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা। তবে এই পরিমাণে ধনেপাতা ও পুদিনা পাতা মাসখানেক আগে ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ইফতারে শরবত তৈরিতে ব্যবহৃত-ইসবগুলের ভুসি, ট্যাঙ, রুহ-আফজার দামও বাড়ানো হয়েছে। বাজার ঘুরে ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি ইসবগুলের ভুসি এক মাস আগে ৬৫০-৮০০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৭৫০-৯০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত ট্যাঙ বিক্রি হয়েছে ১৩৫০ টাকা, যা আগে ১২০০ টাকা ছিল। ২৭৫ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি লিটার রুহ-আফজা মাসের ব্যবধানে বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা।

মুদি ব্যবসায়ী সাক্কুর আলম বলেন, রমজান ঘিরে সব পণ্যের দাম বেশি। পাইকাররা গত দুই মাস থেকে ধীরে ধীরে সব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সর্বশেষ গত এক মাসে নতুন করে রমজাননির্ভর পণ্য- ছোলা, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, আদা, রসুনের দাম বাড়িয়েছে। এমনকি ইফতার তৈরি আইটেমগুলোর দামও বাড়িয়েছে। যে কারণে বাড়তি দরে এনে বাড়তি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নিয়মিত বাজার তদারকি হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিনের ঝটিকা অভিযানে একাধিক পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। রমজান ঘিরে এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোনো অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More