যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক মুজিবনগরের বিশাল আম্রকানন
স্মৃতিসৌধ-জাদুঘর-মানচিত্রে স্বাধীনতার ইতিহাস
স্টাফ রিপোর্টার: দর্শনা থেকে কেদারগঞ্জগামী সড়ক। ২৬ কি. মি। ২ কি. মি এগিয়ে গেলেই মুজিবনগর কমপ্লেক্সে প্রবেশপথ। গেট পেরিয়েই ‘সূর্যোদয়’ রেস্ট হাউস। জেলা পরিষদের আওতাধীন। আরও গণর্পূত ও পর্যটন মোটেলের রেস্ট হাউসও আছে। ৫০০ গজ যেতেই শিহরিত হলাম। ২৩টি পিলারের স্মৃতিসৌধ। আমাদের গর্বের। তানভীর কবিরের আঁকায় এ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। বৈদ্যনাথতলাকে স্বাধীনতার সূতিকাগার বলা হয়। বৈদ্যনাথতলার বর্তমান নাম মুজিবনগর। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকারের (প্রথম সরকারের) শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানও এখানকার আ¤্রকাননে হয়। তারই স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। স্মৃতিসৌধের দিকে যেতেই এগিয়ে আসেন একজন। নিজের নাম বলে হ্যান্ডসেক করলেন। তার নাম সুভাষ মল্লিক। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি পাশের ভবেরপাড়া গ্রামে। শপথ অনুষ্ঠানের অনেক কিছুর সাক্ষী। বলে গেলেন ইতিহাস। ইংরেজী ও বাংলার মিশ্রণে তার উপস্থাপনা বেশ চমৎকার। স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব। অনেক না জানা ইতিহাস। তিনি নিজের ইচ্ছাতেই এখানে থাকেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন স্মৃতিসৌধের পুরো এলাকা। আর দর্শনার্থীদের বুঝিয়ে দেন ইতিহাস। জানিয়ে দেন মুজিবনগরের মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু ইতিহাসও। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের হেডকোয়ার্টার্স তৈরি করা হয় এখানে। ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। স্মৃতিসৌধটি ২৩টি ত্রিভুজাকৃতির দেয়ালের সমন্বয়ে গঠিত। ২৩টি দেয়ালই পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনের প্রতীক (আগস্ট ১৯৪৭ থেকে মার্চ ১৯৭১)। ৩৯.৩৭ একর জমির ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয় ১৯৭৮ সালে। আড়াই ফুট উচ্চতার গোলাকার বৃত্তে শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন স্থান পেয়েছে। ৭ কোটি সংগ্রামী মানুষের প্রতীক প্রতিফলিত হয়েছে ৩ ফুট উচ্চতায় নির্মিত অপর বেদিটিতে। স্মৃতিসৌধের ভেতরে মাঝখানে একটি আয়তকার লাল মঞ্চ দেখিয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ মল্লিক জানান, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এখানেই শপথ গ্রহণ করে। ২৪ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ফুট প্রশস্ত সিরামিকের ইট দিয়ে তৈরি এটি। প্রথম দেয়ালটির উচ্চতা ৯ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ্য ২০ ফুট। পরবর্তী প্রতিটি দেয়ালকে ক্রমান্বয়ে দৈর্ঘ্য ১ ফুট ও উচ্চতা ৯ ইঞ্চি করে বাড়ানো হয়েছে; যা দ্বারা বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার জন্য ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করেছিলো। শেষ দেয়ালের উচ্চতা ২৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, প্রতিটি দেয়ালের ফাঁকে অসংখ্য ছিদ্র আছে, যেগুলোকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচারের চিহ্ন হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধটির ভূমি থেকে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু বেদিতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত রয়েছে; যা দ্বারা এক লাখ বুদ্ধিজীবীর খুলিকে বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের ভূমি থেকে ৩ ফুট উচ্চতার বেদিতে অসংখ্য পাথর রয়েছে; যা দ্বারা ৩০ লাখ শহীদ ও মা-বোনের অত্যাচারের দিক তুলে ধরা হয়েছে। পাথরগুলোর মাঝখানে ১৯টি রেখা দ্বারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯টি জেলাকে বোঝানো হয়েছে। বেদিতে আরোহণের জন্য ১১টি সিঁড়িকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ১১টি সেক্টরকে বোঝানো হয়েছে। স্মৃতিসৌধের মূল ফটকের রাস্তাটি মূল স্মৃতিসৌধের রক্তের সাগর নামক ঢালকে স্পর্শ করেছে। ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী অর্থে এটি করা হয়েছে। স্মৃতিসৌধের পশ্চিম পাশে প্রথম দেয়ালের পাশ দিয়ে শহীদের রক্তের প্রবাহ তৈরি করা হয়েছে; যাকে রক্তসাগর বলা হয়। তথ্যগুলো গড়গড় করে বলেই চললেন সুভাষ মল্লিক। স্মৃতিসৌধ দেখে মানচিত্র কমপ্লেক্সের দিকে রওনা দিলাম আ¤্রকাননের মধ্য দিয়ে। ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ দোকান; পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকে। পাশেই ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ। আপনি বা আপনার বাচ্চাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। হেরিংবন্ডের সরু রাস্তা বেয়ে মুক্তিযুদ্ধ কমপেক্সে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহৎ এক মানচিত্র। মানচিত্রে কী কী আছে: মানচিত্রের বুকে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতের উদ্দেশে শরণার্থীগমণ, পাকসির ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ ধ্বংসের চিহ্ন, পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, কাদেরীয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, পাক বাহিনীর সঙ্গে কামালপুর-কুষ্টিয়া-মীরপুরসহ বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধ, শুভপুর ব্রিজের দু’পাড়ের মুখোমুখি যুদ্ধ, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীতে পাক বাহিনীর হত্যাযঞ্জ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, জাতীয় প্রেসক্লাবে হামলা, সচিবালয়ে আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হলের ধ্বংসযজ্ঞ, তৎকালীন ইপিআর পিলখানায় আক্রমণ, রায়েরবাজার বধ্যভূমি, বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মৃতি ভাস্কর্য। মানচিত্রের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নদীর নিশানা। যা গিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্সের বাইরের ভাস্কর্য একেকটি ইতিহাস: বাইরে বড় ম্যুরালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত্রির হত্যাযজ্ঞ, পাক বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানী, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এ মুজিবনগরে দেশের প্রথম সরকারের শপথ ও সালাম গ্রহণ, মেহেরপুরের স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য কর্তৃক ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ সরকার প্রধানদের গার্ড-অব-অনার প্রদান, সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় ১১ জন সেক্টর কমান্ডারের গোপন বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের সেক্টর বণ্টন সভা, অরোরা-নিয়াজী ও একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাক বাহিনীর আত্মসর্মপণের চিত্র ভাস্কর্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাদুঘর: আনসার সদস্যদের একটি দল এ জাদুঘর পাহারা দেয়। তাদের অনুমতি নিয়ে জাদুঘরে ঢুকে পড়লাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকার আবক্ষ মুর্তিসহ ৪০টি ভাস্কর্য শিল্পকর্ম নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মধ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান, উপ-প্রধান, বীরউত্তমদের, জাতীয় চার নেতা, তারামন বিবি, সেতারা বেগমের মূর্তমান ছবিসহ ব্রোঞ্জের তৈরি ২৯টি আবক্ষ ভাস্কর্য, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৩০ নেতার তৈলচিত্র রয়েছে। শপথগ্রহণকালীন ব্যবহৃত চেয়ারগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিশাল আ¤্রকানন: বিশাল আম্রকানন যুদ্ধের স্মৃতি ধরে আছে এখনও। আমের মুকুলে ম-ম করছে। আ¤্রকানন বা আম বাগান। বাগানটির মালিক ছিলেন মেহেরপুরের ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারেই জায়গাটির নাম হয় ‘বৈদ্যনাথতলা’। পাশের গ্রামের এখানকার দোকানদার সামসুল জানান, প্রায় ৮০ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। আ¤্রকাননের জায়গার পরিমাণ প্রায় ৪০ একর। এখানে আমগাছ রয়েছে ১৩০০টি। জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু তার স্ত্রীর আচারের জন্য এখানে আমবাগান তৈরী করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সারি সারি আমের গাছ যেকোন মানুষের নজর কাড়বে। যেদিকে তাকাবেন সেদিকে সরু লাইন দিয়ে ছায়া সুনিবিড় আম গাছগুলো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
তিনটি ধাপে ছয় স্তরবিশিষ্ট দুটি গোলাপ বাগান; যা ৬ দফা আন্দোলনের রূপক। এসব তথ্য দিলেন সুভাষ মল্লিক ও কয়েকজন এলাকাবাসী।
ভারত-বাংলাদেশের ‘নোম্যান্স ল্যান্ড’ ঐতিহাসিক বেলতলা: এটি কমপ্লেক্সের বাইরে। আধা কিলোমিটারের মধ্যেই ভারতীয় সীমানা। ১ কিমি গেলেই ‘জিরোপয়েন্ট’ বা দু’দেশের ‘নো-ম্যান্সল্যান্ড’। এখানেই ঐতিহাসিক বেলতলা। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে দুই দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ জায়গায় জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। তবে সরকারের সচিবের সহযাত্রী হওয়ায় ২০ ফেব্রুয়ারি প্রবেশের সৌভাগ্য হয়েছে। চারিদিকে দুই দেশের আবাদের জমি। বেশি উচ্চতার গাছ লাগাতে দেয়া হয় না সীমান্ত এলাকায়।
আবাসিক ও সরকারি অন্যান্য স্থাপনা: এই কমপ্লেক্সের ভেতর সমাজসেবা অধিদফরের শিশু পরিবারসহ বেশ কয়েকটি দফতরের অফিস/রেস্ট হাউস ও স্থাপনা রয়েছে। এখানে আছে বঙ্গবন্ধু তোরণ, অডিটোরিয়াম, শেখ হাসিনা মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কেন্দ্র, মসজিদ, হেলিপ্যাড, সৌদি খেজুর গাছ ইত্যাদি। নান্দনিক স্থাপনার মধ্যে ফল-ফুল বাগানগুলো দেখতে দারুণ লাগে। মুজিবনগরকে করা হয়েছে উপজেলা। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ২০১০ সালে থানা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে পাশেই রতনপুরে ক্যাম্প ভবনে মুজিবনগর থানার কার্যক্রম ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল এ কমপ্লেক্সের কোথাও দর্শন করতে কোনোপ্রকার প্রবেশ ফি লাগে না। সময় নিয়ে ঘুরলে মনের অজান্তেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাস জানা হয়ে যাবে।
যেভাবে যাবেন: দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সরাসরি মুজিবনগর যাওয়া যায়। এছাড়া বাসে মেহেরপুর জেলায় নামতে হবে। তারপর প্রায় ১৭ কিমি দূরের মুজিবনগরে সহজেই যাওয়া যায়। এছাড়া ট্রেনে গেলে চুয়াডাঙ্গা বা দর্শনাতে নেমে বাসে বা অটোতে মেহেরপুর/মুজিবনগর যাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে দূরত্ব ২৫-৩০ কি.মি।
থাকা ও খাওয়া: মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হোটেলে আবাসনের সুব্যবস্থা আছে। এছাড়া জেলা পরিষদের স্থাপিত ডাক-বাংলোয় (নাম সূর্যোদয়) ৩টি ভিআইপি কক্ষে আবাসনের ব্যবস্থা আছে। মেহেরপুর জেলা সদরে সার্কিট হাউস, পৌর হলসহ অন্যান্য আবাসিক হোটেলেও আবাসনের সুব্যবস্থা রয়েছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More