।। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী।।
আরবি ভাষায় আ’শারা অর্থ ১০। এ কারণে ১০ই মহররম আমাদের দেশে আশুরা নামে পরিচিত। আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হলো মহররম। এ মাস দিয়েই শুরু হয় আরবি নববর্ষ । আগামী ৩০ আগস্ট রোববার সারা দেশে পবিত্র আশুরা (১০ মহররম) পালিত হবে।এ মাসে, বিশেষ করে আশুরার দিনে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হবার কারণেমুসলিম বিশ্বে আশুরার ব্যাপক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনে বনি ইসরাইলের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আবার এই একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন (বুখারী ১/৪৮১)। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের মধ্যে একটি। এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।আশুরার রোযার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ মাফ হয়ে যায় বলে হাদিসে এসেছে।
আশুরার গুরুত্ব ও মহত্ব:
তৎকালীন আরব সমাজে আশুরার গুরুত্ব এতো বেশী ছিল যে, এই দিন পবিত্র কাবা শরীফে গিলাফ পরানো হতো। আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে মুসলিমগণ আশুরারোযা পালন করতেন। সে দিনই কাবাঘর গিলাফে আবৃত করা হতো। তারপর আল্লাহ যখন রমযানের রোযা ফরয করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আশুরার রোযা যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা সে ছেড়ে দিবে (বুখারী:১৪৯৭।
শুধু মুসলামান নয়, অন্যান্য জাতি যেমন ইয়াহুদী সম্প্রদায়েরর কাছেও মুহররম ও আশুরার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। নবী (স.) ও সাহাবায়ে কেরামের (রা.) যমানায় মদিনাতে অনেক ইয়াহুদী বাস করতো। তাদের কাছে আশুরার দিনটি ছিল ঈদের মতো। কারণ, এই দিন মুসা (আ.) ও তার অনুসারী বনী ইসরাঈলকে মহান আল্লাহ তায়ালা ফেরআউনের কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে সদলবলে পানিতে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করেছিলেন। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ আশুরার দিনে রোযা পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি ব্যাপার তোমরা এ দিনে রোযা পালন কর কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল্লাহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আ.) রোযা পালন করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে রোযা পালন করেন এবং রোযা পালনের নির্দেশ দেন (বুখারী:১৮৭৮)।আর এক হাদিসে আবূ মূসা (রাঃ) বলেন, ইয়াহুদী সম্প্রদায় আশুরার দিবসের সম্মান প্রদর্শন করত এবং তারা এ দিনকে ঈদ বলে গণ্য করত। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরাও এ দিনে রোযা পালন কর (মুসলিম:২৫৩১)।
আশুরার রোযার ফজিলত:
রমযান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হলো আশুরার রোযা। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ও আশুরার যেরুপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময়তা দেখিনি (বুখারী ১/২১৮)।এর মধ্যে আশুরার রোযার ফজিলত আরও বেশি।আবু কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলার নিকট আমি আশাপোষণ করি যে, তিনি আশূরার রোযার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের (গুনাহ) ক্ষমা করে দিবেন (মুসলিম)। আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমযান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা (সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮)।
আশুরার রোযা একটি পুরা জাতির জন্য নাজাতের ওছিলা হতে পারে। হযরত আলী রা.কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন (জামে তিরমিযী ১/১৫৭)। বিশেষ করে এই করোনা মহামারীতে গোটা জাতির জন্য আশুরার রোযা কাফফারার কাজ করতে পারে।
আশুরার রোযাকে সাহাবায়ে কেরামের এত বেশী কদর করতেন যে, ছোট ছোট বাচ্চারা এই দিন রোযা রাখতো। এক হাদিসে বর্ণিত আছে, আশুরার সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের সকল পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেনঃ যে ব্যাক্তি রোযা পালন করেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে, আর যার রোযা অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন রোযা পূর্ণ করে। হাদিসের বর্ণনাকারী সাহাবী (রাঃ) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন রোযা রাখতাম এবং আমাদের শিশুদের রোযা রাখাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরী করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁধলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ইফতার পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখতাম (বুখারী:১৮৩৬)।
আশুরার রোযার পদ্ধতি:
যেহেতু ইয়াহুদীরা শুধুমাত্র এক দিন অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখে রোযা রাখতো, সেকারণে মাত্র এক দিন রোযা না রেখে ন্যুনতম দুই দিন রোযা রাখা উত্তম বলে হাদিসে উল্লেখ আছে। সে কারণে ১০ মহররমের সাথে আগে বা পিছে এক দিন মিলিয়ে মোট দুই দিন রোযা রাখতে হবে। আশুরার রোযা সম্পর্কে হাদীসে আছে যে, তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করো; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)।আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আর একটি সহিহ হাদিসেবর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার দিন রোযা পালন করেন এবং লোকদেরকে রোযা পালনের নির্দেশ দেন তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইয়াহূদী এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও রোযা পালন করব। বর্ণনাকারী বলেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকাল হয়ে যায় (মুসলিম:২৫৩৭)।হাকাম ইবনুল আ‘রাজ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি ইবন আব্বাস (রাঃ) এর নিকট এমন সময় গমন করি, যখন তিনি স্বীয় চাদর মস্তকের নীচে (বালিশের ন্যায়) প্রদানপূর্বক কা‘বা ঘরে শায়িত ছিলেন। আমি তাঁকে আশুরার রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, যখন তোমরা মুহাররমের নতুন চাঁদ দেখবে, তখন গণনা করতে থাকবে। যখন ৯ তারিখ আসবে, তখন তুমি রোযা রাখবে। এরপর আমি জিজ্ঞাসা করি, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এরূপ রোযা রাখতেন? তিনি বলেন, এরূপেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রাখতেন। অর্থাৎ মুহাররামের ৯ তারিখের রাতে সাহরী খেয়ে ১০ তারিখ রোযা রাখবে। অথবা ৯ ও ১০ উভয় দিনই রোযা রাখবে (আবু দাউদ:২৪৩৮)। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে আরও একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি আগামী বছর বেঁচে থাকলে অবশ্যই (মুহাররমের) নবম তারিখে রোযা রাখবো (মুসলিম ১১৩৪)।
তবে মনে রাখতে হবে যে, আশুরার রোযা ঐচ্ছিক বা নফল। এ প্রসঙ্গে আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, জাহিলী যুগে কুরায়শগণ আশুরার দিন রোযা পালন করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও পরে এ রোযা পালনের নির্দেশ দেন। অবশেষে রমযানের রোযা ফরজ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যার ইচ্ছা আশুরার রোযা পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে রোযা পালন করবে না (বুখারী: ১৭৭২)।
আশুরাকেন্দ্রিক কুসংস্কার:
এ কথা সত্য যে, আশুরার দিনে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন; ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন; ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন; ইদরীস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার এটাও প্রচলিত আছে যে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথাকুরআন-হাদিসে উল্লেখ নেয় বিধায় তার কোন কোনো ভিত্তি নেই।
এ মাসের আর একটি ঘটনা হল হুসাইন রা.-এর শাহাদত। এটা উম্মতের জন্য নিঃসন্দেহে বড় একটি শোকের বিষয়। তবে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছেড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিৎ যে, আমাদের মুখ থেকে এমন কোন কথা যাতে না বের হয় যাতে মহান আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন। হুসাইন রা.-এর শাহাদতকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকা-ে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য।আশুরা ও মহররম কেন্দ্রিক যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে; শোক পালন, শোক মাতম, শোকগাঁথা পাঠ, শোক মিছিল ও জমকালো র্যালী, তাজিয়া, শোকে জামা-কাপড় ছিড়া, বুক চাপড়ানো, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। এগুলো সবই কু-প্রথা। অনেকে আবার এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করেন এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ মাসে করতে চান না। যেমন অনেক মুসলমান এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকেন। এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।তওবা- ইস্তেগফার, নফল রোযা এবং অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে আমাদের এই মাসটি কাটানো উচিৎ । বিশেষ করে আশুরার রোযা রাখা সুন্নত এবং সাহাবায়ে কেরাম এই রোযার এহতেমাম করতেন। তাই আসুন, আমরা সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে সুন্নত-মোতাবেক আমল করি। লেখক:অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ।