অসচেতনতা ও চিকিৎসা সঙ্কটের ঘোরটোপে মৃত্যুর হার বাড়ছে

সংক্রমণের গতিরোধ করতে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও ভ্যাকসিনেশন জরুরি
স্টাফ রিপোর্টার: দেশে গোটা জুলাইয়ে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন মৃত্যুর রেকর্ড তৈরি হয়েছে। চিকিৎসকরা এজন্য রোগীদের অসচেতনতাকেই প্রধানভাবে দায়ী করছেন। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এজন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাকেই দুষছেন। এছাড়া দেশে ছড়িয়ে পড়া ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে না পারা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় চরম সমন্বয়হীনতা, প্রান্তিক পর্যায়ে চিকিৎসার সামর্থ্য বাড়াতে না পারা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা এবং সময় উপযোগী ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল তৈরি না করার ব্যর্থতা মৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণ বলেও মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি, তাতে দেশের নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারে এবং এতে মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ার পরও অনেক মানুষ পরীক্ষা না করে এমনিতে ভালো হয়ে যাওয়ার আশায় বসে থাকছে। অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ার পর হাসপাতালে আসছে। চিকিৎসা ভালোভাবে শুরুর আগেই তাদের অনেকে মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তির ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্য মারা যাওয়ার রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়েছে। সময়মত হাসপাতালে এলে এদের অনেককে বাঁচানো যেত বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা।
তবে করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অসচেতনতার কারণে রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসছে তা নয়। অনেক সচেতন রোগী উপসর্গ দেখা দেয়ার পর থেকেই চিকিৎসা সেবার আওতায় আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে- এ নজিরও অসংখ্য। তাদের ভাষ্য, মহামারির এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও অনেক জেলা হাসপাতালে আইসিইউ দেয়া যায়নি, সেবাও নিশ্চিত করা যায়নি। বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের পাশাপাশি চিকিৎসক-নার্স ও টেকনিশিয়ানের সংকট রয়েছে। করোনা সংক্রমণ বাড়ার পর থেকেই হাসপাতালে আইসিইউ শয্যার হাহাকার দেখা দিয়েছে। ফলে অনেক রোগী এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতেই মারা যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পূর্ববর্তী ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অন্তত ৬০ শতাংশ বেশি সংক্রমক। এছাড়া পূর্ববর্তী ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ। এই ভেরিয়্যান্ট সহজে ছড়ায় এবং ফুসফুসের কোষের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত সহজে যুক্ত হয়। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবহৃত টিকা যে মূলনীতি অনুসারে তৈরি করা হয়, ‘মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপি’ তার বিরুদ্ধে কার্যকর।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত, এ পরিস্থিতিতে ট্রিটমেন্ট প্রোটোকলে পরিবর্তন করা জরুরি। কোন রোগী কখন হাসপাতালে ভর্তি হবে, সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও আগের গাইড লাইন মানলে হবে না। কেননা, এখন অনেক রোগীর দ্রুত শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। সময়মত চিকিৎসা শুরু না করলে অনেকে অক্সিজেনও নিতে পারছে না। অথচ এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সব মিলিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
কোভিড চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত চিকিৎসকরা বলছেন, তথ্য সঙ্কটের কারণেও অনেক রোগী সময়মত সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। কোনো হাসপাতালে গেলে আইসিইউ বেড পাওয়া যাবে, কোথায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে- তা সাধারণত রোগী ও তার স্বজনদের জানা থাকে না। এ কারণে তারা শ্বাসকষ্টে ভোগা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে থাকে। যখন আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা হয়, তখন আর তাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। চিকিৎসকরা জানান, কোথায় গেলে আইসিইউ পাওয়া যাবে, সহজেই তা জানানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একটি হটলাইন নম্বর থাকতে পারে, যেখানে ফোন করে জানা যাবে কোথায় আইসিইউ ফাঁকা আছে; কোথায় কত সাধারণ শয্যা শূন্য আছে। এতে রোগী নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘোরাঘুরি বন্ধ হবে। গুরুতর অসুস্থ রোগীরা সময়মত চিকিৎসা পাবে।
মৃত্যুরহার বৃদ্ধির জন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম চিকিৎসা খাতের চরম অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে বলেন, মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর গত এক বছরে যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিলো, তা করতে পারেনি সরকার। সঠিক সময়ে সঠিক সেবা খুঁজে না পেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।
ডা. নজরুল বলেন, এক বছর হয়ে গেলো, কিন্তু এখনও জেলায় জেলায় হাসপাতাল হলো না। আইসিইউ হলো না। জেলা থেকে ঢাকায় আসতে আসতে রাস্তাতেই রোগী মারা যাচ্ছে। এছাড়া কয়জনেরই ঢাকায় আসার ক্ষমতা আছে? কয়জনের গাড়ি ভাড়া করার টাকা আছে? এখনও জনগণের দোরগোড়ায় কেন চিকিৎসা সেবা পৌঁছালো না?
এদিকে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অনেকে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসক-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী ও আইসিইউসহ বিভিন্ন সংকটের কথা মেনে নিলেও মৃত্যুর হার বৃদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকে সমানভাবে দায়ী করেছেন। একাধিক সরকারি হাসপাতালের মেডিকেল অফিসাররা জানান, প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক কোভিড পজিটিভ রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যারা সাধারণ সর্দিজ্বরে আক্রান্ত ভেবে এতদিন নমুনা পরীক্ষা করাননি। আবার অনেকে কোভিড পজিটিভ হয়ে যাবার ভয়ে টেস্ট করাতে চাননি। অথচ পথঘাটে ঘোরাঘুরি করেছেন, বিভিন্ন জনসমাগমে গেছেন। অসচেতন এসব রোগীর অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে শেষ সময়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। তখন চিকিৎসকদের আর তেমন কিছু করার থাকছে না। সম্প্রতি এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবি করেন তারা। বর্তমানে মৃত্যুর সংখ্যার নেপথ্যে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংক্রমণের উচ্চহার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ এবং বিলম্বিত চিকিৎসার কারণে মৃত্যুর হার হু হু করে বাড়ছে। এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, প্রান্তিক পর্যায়ে করোনার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। যে কারণে জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে রোগীদের বিভাগীয় শহরে ছুটতে হচ্ছে। ঢাকার হাসপাতালে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মফস্বলের রোগীতে ভর্তি। স্বাভাবিকভাবেই প্রান্তিক পর্যায় থেকে তাদের ছুটে আসতে বিলম্ব হচ্ছে। এতে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের অনেকের অক্সিজেন লেভেল ৮০-এর নিচে নেমে আসছে। অথচ ঢাকায় এসেও অনেকে আইসিইউ বেড, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কিংবা সাধারণ শয্যা রাতারাতি যোগাড় করতে পারছে না। এসব রোগীর বেশিরভাগই মারা যাচ্ছে।
জাতীয় পরামর্শক কমিটির এই সদস্য উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আক্রান্ত রোগীর ১ শতাংশের অবস্থাও যদি ক্রিটিক্যাল হয় তবে প্রতিদিন দেড়শ’ রোগী এ তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। এ হিসেবে এক সপ্তাহে এর সংখ্যা হাজারের কোটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যাদের আইসিইউ, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মতো ডিভাইস প্রয়োজন। অথচ এসব রোগীর সুস্থ হতে ৭ থেকে ১০ দিন সময় লাগছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দিন দিন ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ এ প্রসঙ্গে বলেন, করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। দু’সপ্তাহের কঠোর লকডাউন দেয়া হয়েছে। লকডাউন সংক্রমণের গতি কিছুটা রোধ করতে পারলেও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা ও ভ্যাকসিনেশন জরুরি। তা না হলে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More