কঠোর লকডাউন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা : সবার সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

স্টাফ রিপোর্টার: করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কঠোর লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এমন অবস্থানকে সমর্থন করলেও লকডাউনের প্রভাবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কতো মানুষ বেকার হবে এবং সরকারি চাকরিজীবীর বাইরে সাধারণ মানুষ কিভাবে তাদের সংসারের ব্যয় বহন করবে তা ভেবে দেখার আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া কঠোর লকডাউনের প্রাক্কালে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে এমন আবেদন জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী মহলসহ সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীরা। শনিবার তাদের অনেকে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে কঠোর লকডাউন আরোপ করে সার্বিক অর্থনীতির চাকাকে কিভাবে সচল রাখা হবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এদের বেশিরভাগই দিন আনে, দিন খায়। মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতেই বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলে এদের বেতন-ভাতায় আঘাত আসে। চাকরিচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তো রয়েছেই। আছে ব্যাংকের দায়-দেনা ও কিস্তি পরিশোধের চাপ। দায়িত্বশীল মহল থেকে এসব প্রশ্নের সঠিক জবাবও আসতে হবে। ফলে কঠোর লকডাউন আরোপিত হলে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় মোটা দাগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একেবারে রাস্তার ভিক্ষুক থেকে সমাজের উচ্চবিত্ত শিল্পপতিরাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। যে যতো বড়, তার ক্ষতির পরিমাণ ততো বেশি হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান শনিবার বলেন, ‘করোনাকালীন আর্থিক প্রণোদনা সহায়তার ব্যাপারে আগের অবস্থানেই আছে সরকার। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু করোনা এখনও শেষ হয়নি। যেহেতু নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রণোদনাসহ অন্যান্য নীতি সহায়তা বহাল থাকবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে প্রণোদনা ঋণের বড় অংশ পেয়েছে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীরা। কারণ তারা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট। তাদের সহজে খুঁজে বের করা যাবে। সে বিবেচনায় এবারও সরকার এগিয়ে আসবে। তবে এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন। শ্রমিকরা যাতে চাকরিচ্যুত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হবে।’ এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ শনিবার বলেন, এই লকডাউন অর্থনীতিকে ল-ভ- করে দেবে। আর অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে আনলে সব খাত বিপদে পড়বে। ভিজিলেন্স বা চলমান অর্থনীতি যারা পড়েছেন, এমন কেউ লকডাউনের পক্ষে কথা বলবেন না। তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যাংক বিপদে পড়বে, শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বন্ধ হবে, শ্রমিকদের মজুরি বন্ধ হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয়ও কমবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমার অত্যন্ত দুঃখ লাগে যে, টেলিভিশনে কেউ কেউ লকডাউনের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তাদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন, এক সপ্তাহ পর কী করোনা দেশ থেকে চলে যাবে। যদি না যায়, তবে অর্থনীতির গতি থামিয়ে দেয়ার মানে কী? এর দায় কে নেবে? ওইসব লোকদের আমি বলতে চাই, আগে অর্থনীতি বোঝেন, পরে মন্তব্য করেন। কিন্তু লকডাউনের মতো সিদ্ধান্তে পুরো দেশের অর্থনীতি এবং আর্থসামাজিক খাতে কী প্রভাব পড়বে, উনারা সেটি ভাবেন না। সামনে ঈদ চলে আসছে। সব খাতের মানুষের এ সময়ে আয় বাড়ে। আর ঈদকে সামনে রেখে সব উদ্যোক্তাই যার যার জায়গা থেকে নতুন বিনিয়োগ করেছেন। কারণ প্রতি বছর এ সময়ই অর্থনীতির গতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সময়। আর গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে লকডাউন দিয়ে অর্থনীতির ক্ষতি করার মানে কী?’ ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট অনেকে অধ্যাপক আবু আহমেদের মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে জানিয়েছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। কেননা লকডাউনের প্রভাবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। এতে উদ্যোক্তারা যেসব পণ্য তৈরি করে বাজারজাত করছেন বা করবেন, সেগুলো বিক্রি করা সম্ভব হবে না। রপ্তানিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বায়ারদের অর্ডার বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাংক থেকে সুদের হিসাব কষা থামবে না। এ করোনার মধ্যেও ঋণের কিস্তি ঠিকই দিতে হচ্ছে। এখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় ধাক্কা।
এদিকে এ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়াসহ অন্যান্য খরচও মেটাতে হচ্ছে। সামনে আসছে ঈদ। সেখানে সময়মতো বেতন-ভাতা পরিশোধের বড় চাপ তো অপেক্ষা করছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেখানে করোনার প্রথম ধাক্কার ক্ষতি এখনও উদ্যোক্তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি; সেখানে দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হয়ে গেছে। ফলে সব কিছু তছনছ হতে বসেছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এ ধাক্কার প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে এবং সরকার যদি উদ্যোক্তাদের পাশে শক্তি সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয় তাহলে সবার পথে বসার উপক্রম হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যাবে। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনার সংক্রমণ রোধে লকডাউনের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি অর্থনীতিকে সচল না রাখারও কোনো বিকল্প পথ নেই। তারা মনে করেন, করোনার প্রকোপ থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে হলে যেমন কঠোর লকডাউনের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি সামগ্রিক অর্থনীতিসহ কোটি কোটি মানুষের সংসার বাঁচাতে কার্যকর কিছু একটা করতে হবে। ফলে সরকারকে এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় করে মানুষের জীবন ও জীবিকার সমাধানে ভূমিকা রাখতেই হবে।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পের অগ্রসর ও পশ্চাৎপদ শিল্পকে লকডাউনের আওতায় আনা কোনো ক্রমেই উচিত হবে না। কারণ গত বছর লকডাউনের পর কারখানা খুলে দিলে এ খাতে তেমন সমস্যা হয়নি। তাছাড়া এখন প্রতিটি রপ্তানিমুখী কারখানাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালনা করা হচ্ছে। বরং কারখানা বন্ধ করে দিলে বেতন-বোনাসের দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। শুক্রবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেছে। এর সংক্রমণ ঠেকাতে ১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে সর্বাত্মক লকডাউন দেয়া হবে। এর আওতায় জরুরি সেবা ছাড়া অন্য সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হবে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, গণপরিবহণও বন্ধ থাকবে। একই দিন একই কথা জানিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, জরুরি সেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হবে। এরপর থেকে মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানসহ আয়-রোজগার চালু রাখা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। এর আগে গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে অর্থনৈতিক কর্মকা- সীমিত হয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির আওতায় চলে লকডাউন। যা টানা ৬৬ দিন অব্যাহত থাকে। এরপর অর্থনৈতিক কর্মকা- সীমিত আকারে সচল করা হয়। একপর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সেক্টর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়। লকডাউনের সময় সীমিত আকারে বিশেষ করে রপ্তানি, উৎপাদন ও ভোগ্যপণ্যের কার্যক্রম চলছিল। তবে ওই সময়ে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছিল তা কাটিয়ে উঠতে সরকার ২১টি প্যাকেজের আওতায় এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। যা দেশের মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১১টি রয়েছে ঋণনির্ভর। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোট প্যাকেজের ৫৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ৪৪ শতাংশ বাস্তবায়নের জন্য প্যাকেজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের কারণে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। প্রণোদনা নিয়েও উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। তবে তারা যখন আগের ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন তখনই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত হামলে পড়েছে। এ অবস্থা সামাল দিতে গত ৫ এপ্রিল থেকে চলা সীমিত আকারের ‘লকডাউনের’ মেয়াদ শেষ হবে আজ রোববার। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার কথা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথম ধাক্কার ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার থেকে উদ্যোক্তারা প্রণোদনার যে ঋণ নিয়েছেন এবং এর আগের ঋণের কিস্তিও গত জানুয়ারি থেকে পরিশোধ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে সমন্বয় করে পরিশোধ করতে হচ্ছে গত বছর ও চলতি বছরের সুদ। এর সঙ্গে শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা, অফিস খরচসহ অন্যান্য খরচ তো আছেই। লকডাউন আরোপিত হলে ব্যবসা বাণিজ্য সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে টাকার হাতবদল বা ব্যবহারও কমে গেছে। এতে ব্যবসায়ীরা অর্থ সংকটে পড়বে। এর ফলে ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে চেপে বসা দায়দেনা কিভাবে পরিশোধ হবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন। যদিও এ প্রশ্নের সদুত্তর দায়িত্বশীল মহলের অনেকে এড়িয়ে গেছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি বছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে ২০ লাখ শ্রমিক। এদের মধ্যে কর্মসংস্থান হচ্ছে ছয় লাখের। বাকি ১৪ লাখই থেকে যাচ্ছে বেকার। করোনার প্রভাবে গত বছরের এপ্রিল-জুলাইয়ে বেকার হয়েছিল ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ মানুষ চাকরিজীবী। সেপ্টেম্বরে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশে। অর্থাৎ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলো। এখন আবার ‘লকডাউনে’ সেই গতি থমকে দাঁড়াবে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চললেও উন্নত দেশগুলোতে চলছে তৃতীয় ঢেউ। এর মধ্যে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশে এখন লকডাউন চলছে। এছাড়া সীমিত আকারে লকডাউন চলছে ব্রাজিল, মালয়েশিয়াতেও। বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশই হচ্ছে এসব দেশের সঙ্গে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো লকডাউন দিলে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার সামর্থ্য আছে। তারা জনগণের ঘরে ঘরে খাবারসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু পৌঁছে দিচ্ছে। যাদের কাজ নেই তাদের ব্যাংক হিসাবে বেকার ভাতা দিচ্ছে। কিন্তু সে রকম সামর্থ্য তো এখনো আমাদের দেশের হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একক দেশ হিসাবে চীনের সঙ্গেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য রয়েছে। এর পরেই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। অঞ্চল হিসাবে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ এবং রপ্তানির ৩ শতাংশ হয় চীনের সঙ্গে। এই বাণিজ্য এখন স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু কঠোর লকডাউন হলে তা বাধাগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া চীন হলো আন্তর্জাতিক পোশাকের বড় পাইকারি বাজার। ফলে দেশে লকডাউনের কারণে ওই বাজার তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ভারত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশ ভেবেচিন্তে এগোনোর কৌশল নিয়েছে।দেশের মোট রপ্তানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মোট আমদানির সাড়ে ১৪ শতাংশ ও রপ্তানির ৩ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে। মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। করোনাভাইরাসের কারণে এসব দেশে এখন নতুন করে লকডাউন আরোপিত হয়েছে। তবে সীমিত আকারে সবদেশই অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রেখেছে। এদিকে করোনার কারণে দেশে গত বছর যারা বেকার হয়েছেন তাদের অনেকে এখনো চাকরি ফিরে পাননি। বিকল্প কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়া অনেকের জন্য কঠিন ও বিব্রতকর। কমপক্ষে ৫৬ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে না নতুন কর্মসংস্থান।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এই দেশে লাখ লাখ লোক বেকার। প্রতি বছর লাখ লাখ লোক নতুন করে শ্রমবাজারে আসে। এতে বেকার সংখ্যা আরও বাড়ছে। কাজের জন্য মানুষ হাহাকার করছে। এ অবস্থায় লকডাউনের চিন্তা কোথা থেকে আসে, আমার বুঝে আসে না। ইউরোপ, আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, জার্মানির মতো উন্নত দেশ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ লকডাউনের ক্ষতি মোকাবেলার সক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে এটি সহ্য করার ক্ষমতা নেই।
আবু আহমেদ প্রশ্ন করে বলেন, লকডাউনের কারণে রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য কী আয়োজন করেছেন? সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, লকডাউনের কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কিছু কম নিতে হবে। সরকার এমন প্রস্তাব দিক। দেখি তারপর তারা লকডাউনের পক্ষে থাকে কিনা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে করোনার প্রভাব মোকাবেলার জন্য বিকল্প চিন্তা করতে হবে। সবার মাস্ক পরাসহ কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে আইসিইউ বেড বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাতেও হাসপাতালের অনুমোদন আরও বাড়াতে হবে। সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে হবে। এই বাইরে করোনা মোকাবেলার ভালো কোনো উপায় দেখি না।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যদি চলতে থাকে তবে শিল্প উৎপাদন এমনিতেই ব্যাহত হবে। করোনা সংক্রমণ ঠেকানো না গেলে লকডাউন দিলে শিল্পের ক্ষতি হবে। এ ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। প্রশ্ন হলো লকডাউন দিয়ে কতটা সংক্রমণ রোধ করা যাবে। যদি এমন হয় দুই সপ্তাহের লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণের হার অনেকটা নামিয়ে আনা সম্ভব। তাহলে পরে এই দুই সপ্তাহের ক্ষতি পোষানো যাবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, টেক্সটাইল শিল্পে এখন ২০০ কোটি ডলারের রফতানির আদেশ রয়েছে। আসন্ন লকডাউনে শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখা হলে এই অর্ডার তো হাত ছাড়া হবেই, উল্টো শিল্প মালিকদের দুর্দশা আরও বাড়বে। কারণ ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে হবে। তা না হলে তারা রাস্তায় নামতে পারে, তখন সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। এ অবস্থায় সরকার যদি লকডাউন দেয়ও সেটা গতবারের মতো দিতে পারে। যে যেই স্থানে আছে, সেই স্থানে থেকে কাজে যোগ দেবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্প-কারখানা কীভাবে চালু রাখা যায় সেজন্য আজ রোববার বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ নেতারা বৈঠকে বসবেন। সেখান থেকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত অর্থবছরের জুলাই ফেব্রুয়ারি আমদানি কমেছিল ৪ শতাংশ। এ বছরের একই সময়ে বেড়েছে ২ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি কমার গতিও হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ক্রেতারা নতুন করে রপ্তানির আদেশ দিচ্ছেন। আগের আদেশ কেউ বাতিল করছেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন লকডাউনের সময় শিল্প খাতের কারখানাগুলো খোলা রাখার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের জুলাই মার্চে রপ্তানি আয় কমেছে শূন্য দশমকি ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল সোয়া ৬ শতাংশ। অর্থাৎ সোয়া ৬ শতাংশের ওপর আরও কমেছে। তবে কমার গতি অনেক হ্রাস পেয়েছে। নতুন রপ্তানির আদেশ আসছে। এ কারণে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানির হার বেড়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, প্রতি বছরই দুই ঈদে শ্রমিকরা বোনাস ছাড়াও বাড়তি উপার্জনের সুযোগ পায়। লকডাউন দিলে শ্রমিকরা তা থেকে বঞ্চিত হবে। বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো লকডাউন দেয়নি, তারা ঠিকই রপ্তানির অর্ডার নিচ্ছে। পক্ষান্তরে ভবিষ্যতে কী সিদ্ধান্ত আসবে তা না জানার কারণে অনেক শিল্প মালিক এখন নতুন অর্ডার নিচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু পোশাক খাতে করোনার সংক্রমণের হার একেবারেই নগণ্য, সে বিবেচনায় রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা যেতে পারে। তা ছাড়া এখন ছুটি দেয়া হলে শ্রমিকরা হয় গ্রামের বাড়িতে যাবে, না হয় পাড়া-মহল্লায় বসে বসে আড্ডা দেবে। আদতে স্বাস্থ্যবিধির কথা কেউ চিন্তা করবে না। তাই এখন পর্যন্ত কারখানা খোলা রাখাটা যুক্তিযুক্ত।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, লকডাউনের নামে সব বন্ধ করা সম্ভব নয়। বরং সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচিগুলো কঠোরভাবে পরিপালন করতে হবে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. শফিকুর রহমান বলেন, সর্বাত্মক লকডাউন হলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক দুর্যোগের আশঙ্কা রয়েছে। তবে লকডাউনে সীমিত আকারে শিল্প কারখানায় উৎপাদন চালু রাখা যেতে পারে। করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোকে আরও সতর্কভাবে ঋণ দিতে হবে। প্রয়োজনে পরিশোধের সময় আবার বাড়াতে হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More