কাজে আসছে না কোটি টাকা মূল্যের ধান কাটা যন্ত্র

মেহেরপুরের তিন উপজেলায় ভর্তূকি মূল্যে ৮২টি কম্বাইন হারভেস্টর

মাজেদুল হক মানিক: শ্রমিক সংকট মোকাবেলা আর দ্রুত ধান ঘরে তোলার উদ্দেশ্যে চাষিদের দেয়া হয়েছে ভর্তূকি মূল্যে কম্বাইন হারভেস্টর। সারা দেশের মতো মেহেরপুর জেলাতেও কোটি কোটি টাকার এ যন্ত্র দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। তবে চাষিরা এ যন্ত্রের ওপর কতোটা নির্ভরশীল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন কারণে কোটি টাকার এই ধান কাটার যন্ত্র তেমন কাজেই আসছে না। বিশেষ করে ধান গাছ দণ্ডায়মান না থাকা এবং জমিতে কাদা থাকায় যন্ত্র ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেবে চলতি বোরো মরসুম পর্যন্ত জেলার তিনটি উপজেলায় ৮২টি কম্বাইন হারভেস্টর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা মূল্যমানের হারভেস্টর রয়েছে। প্রতিটি যন্ত্রে সরকারি ভর্তুকি ৫০ ভাগ।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রকৌশলী সুবল চন্দ্র ম-ল বলেন, কম্বাইন হারভেস্টর দিয়ে ধান ও গম কাটা মাড়াই করা যায়। জেলায় গম কাটা মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে এ যন্ত্রটি অনেক ভালো কাজ করছে। অন্যদিকে ধান কাটা মাড়াইয়েও বেশ সফলতা এসেছে। দুই ধরনের যন্ত্র রয়েছে। একটি হচ্ছে হেড ফিড অন্যটি হোল ফিড। হেড ফিড দিয়ে ধান কেটে শিষ থেকে মাড়াই করা হয়। যা বিচুলি (গো খাদ্য) করা যায়। অপরদিকে হোল ফিড দিয়ে বিচুলি তৈরি করা যায় না। এখানে শুধু খড় পাওয়া যায়।

কম্বাইন হারভেস্টর মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় প্রাপ্ত ৮২টি যন্ত্রের মধ্যে ৫০টির ওপরে হাওর অঞ্চলে নেয়া হয়েছে। জেলায় প্রয়োজনীয় কাজের ক্ষেত্র না থাকায় হারভেস্টর মালিকরা লোকসানে পড়েছেন। দিনের পর দিন হারভেস্টর ফেলে রাখতে হচ্ছে। ধানের দুই মরসুমে কিছুটা কাজ হয় কিন্তু তাতে হারভেস্টর চালকের বেতন ও অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব না। এই যন্ত্র কিনে তারা চরম বিপাকে রয়েছেন বলেনও জানান তারা।

গাংনীর শিশিরপাড়া গ্রামের ধান চাষি আব্দুস সাত্তার বলেন, আমার ধানের জমি নিচু অঞ্চলে হওয়ায় জমিতে কাদা ছিল। এতে ধান কাটার যন্ত্র সেখানে যায়নি। শ্রমিক দিয়ে ধান কাটামাড়াই করতে গিয়ে বেশি খরচ হয়েছে। এক বিঘা জমিতে শ্রমিক খরচ লেগেছে ৫ হাজার টাকা।

গাংনী বাজারপাড়ার মনিরুল ইসলাম বোরো মরসুমে আব্দুস সাত্তারের জমির পাশের জমিতে ধান আবাদ করেন। ধান কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় জাতের ধান লাগিয়ে ছিলাম তাই পাকার আগেই পড়ে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। মেশিন দিয়ে কাটার ইচ্ছে থাকলেও ধান পড়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত শ্রমিক খরচ দিয়ে কাটা মাড়াই করতে হয়েছে।

চাষিরা জানান, মেহেরপুর জেলায় ব্যাপকভাবে গরু পালন করা হয়। আমন ও বোরো মরসুমের ধান আবাদ থেকে গো খাদ্যের জোগান হয়। তাই ধানের পাশাপাশি বিচুলির ওপরে চাষিদের বেশি নজর থাকে। যন্ত্র দিয়ে ধান কাটলে বিচুলি তৈরি করা কঠিন। তাই সনাতন পদ্ধতিতে শ্রমিক দিয়ে ধান কেটে ফেলে রেখে শুকিয়ে তা বিচুলি বাঁধা হয়। এতে ঝড়বৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। অপরদিকে কম্বাইন হারভেস্টরের কাজের ক্ষেত্র ছোট হয়ে যাচ্ছে।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মরসুমে জেলায় চাষিরা জানান, আইটিসি, খাটো বাবু, স্বর্ণাসহ বিভিন্ন অনঅনুমোদিত জাতের ধান আবাদে অনেক চাষি এখনও আকৃষ্ট। এছাড়াও অনুমোদিত জাত ব্রি ধান ২৮ ধান দুর্যোগ সহনীয় নয়। জনপ্রিয় এই ব্রি ধান ২৮ এবং অনঅনুমোদিত জাতের ধান এখনও বেশি পরিমাণ জমিতে আবাদ হচ্ছে। এই জাতের ধানগুলো সামান্য ঝড়েই পড়ে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যায়। ফলে একদিকে যেমনি যন্ত্র দিয়ে কাটা সম্ভব না অন্যদিকে শ্রমিক দিয়ে কাটতে গিয়েও খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

কম্বাইন হারভেস্টর মালিকরা জানান, যন্ত্র ব্যবহারের সুবিধা নিতে হলে ধানকৃত শতভাগ জমিতে আধুনিক জাতের আবাদ করতে হবে। জাত পরিবর্তন করা না গেলে কম্বাইন হারভেস্টর বিতরণ করে লাভ নেই।

কম্বাইন হারভেস্টর দিয়ে ধান কাটা মাড়াই করা চাষির সংখ্যা খুবই কম। তবে যারা মাড়াই করেছেন তারা বেশ সন্তুষ্ট। একইসাথে কাটা ও মাড়াই কাজ সম্পন্ন হওয়ায় ঝড় বৃষ্টির ঝুঁকিও কমেছে বলেও জানান এই চাষিরা।

যন্ত্র দিয়ে ধান কাটার সুযোগ পাওয়া কৃষক রাইপুর গ্রামের সেন্টু মিয়া বলেন, এক বিঘা জমির ধান কাটা মাড়াই করতে খরচ মাত্র দুই হাজার টাকা। যা শ্রমিক খরচের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। কাদা নেই এমন জমি এবং ধান গাছ খাড়া থাকলে যন্ত্রের সুবিধা পাওয়া যায়।

কম্বাইন হারভেস্টর মালিক বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কুতুব উদ্দীন বলেন, ফুল ফিড কম্বাইন হারভেস্টর দিয়ে প্রতিদিন ১৫ বিঘা আর হেড ফিড দিয়ে ৮-১০ বিঘা ধান কাটা মাড়াই করা যায়। জমিতে কাদা পানি ও ধান গাছ দ-ায়মান না থাকায় যন্ত্র চালানোর প্রয়োজনীয় ক্ষেত পাওয়া যায় না। এই যন্ত্র কিনে লোকসানে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।

হারভেস্টরের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এই যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্র বিবেচনা না করেই তিনি এ খাতে বিনিয়োগে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। এখন অনেকটাই গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতদিন পর্যন্ত আধুনিক জাতের ধান আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব না হবে ততোদিন এই যন্ত্রে লোকসান হবে। অপরদিকে হারভেস্টরের মান নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। খুব বেশি বিকল হওয়া এবং সময়মতো যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় লোকসান আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি।

জানতে চাইলে মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপ পরিচালক সামসুল আলম বলেন, শতভাগ জমিতে অনুমোদিত ও সময়োপযোগী ধান জাত আবাদে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আধুনিক ধানের জাত ও চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষিদের যন্ত্রের সুবিধা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More