চিনি কারখানার লোকসান পুষিয়ে ৮০ কোটি টাকা লাভ

কেরুজ কমপ্লেক্সে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে দেড়শ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন

দর্শনা অফিস: দেশের সবগুলো চিনিকল যখন লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে গভীর জলে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখনো সরকারকে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব দিয়েও মুনাফা অর্জন করেছে কেরুজ কমপ্লেক্স। কেরুজ কমপ্লেক্স বরাবরের মতো গত অর্থ বছরেও মুনাফা অর্জন হয়েছে দেড়শ কোটি টাকা। এবার স্মরণকালের রেকর্ডও ভেঙ্গেছে। মিলের ৪টি বিভাগের মধ্যে ৩টি বিভাগেই হয়েছে লাভ। সরকারের রাজস্ব খাতায় ১৪৫ কোটি জমা দিয়েও চিনি কারখানায় সাড়ে ৬৮ কোটি টাকা লোকসান পুষিয়ে মূল মুনাফার খাতায় জমা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮০ কোটি টাকা। কেরুজ কমপ্লেক্স আরও লাভজনক করতে গ্রহণ করা হয়েছে নানামুখি পদক্ষেপ। তবে আধুনিক প্রযুক্তিতে আখ চাষ করায় আগামী মাড়াই মরসুমে চিনি কারখানায় লোকসানের বোঝা কমতে পারে অনেকাংশে। কেরুজ কমপ্লেক্সের বয়স পেরিয়েছে ৮৫ বছর। জোড়াতালি দিয়েই বারবার আখ মাড়াই মরসুমের কার্যক্রম চালু করা হয়ে থাকে। খানেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে কোনোভাবে শেষ করা হয়ে থাকে আখ মাড়াই কার্যক্রম। লাগাতার যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে নাজেহালে হতে হয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। একই দশা ডিস্টিলারি কারখানাতেও। তবে চিনি কারখানার যেমন আধুনিকায়নের কাজ চলছে তেমনি ডিস্টিলারি বিভাগে ফরেণ লিকার উৎপাদনে অটোমেশিন স্থাপন করা হচ্ছে। দিন বিশেকের মধ্যে অটো মেশিন স্থাপনের কাজও হবে শেষ। এ ছাড়া মিলের প্রতিটি বিভাগেই উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে। বিএমআরই সহ প্রায় দেড়শ কোটি টাকা ব্যায়ে বেশ কয়েকটি বিভাগে উন্নয়নের কাজ চলছে তড়িৎ গতিতে। চিনি কারখানা আধুনিকায়নের কাজ শেষে হলেও কিছুটা হলেও কমতে পারে লোকসান। পাশপাশি কৃষকরা আখ চাষ বাড়ালে হয়তো লোকসানের রেকর্ড ভেঙ্গে লাভের মুখও দেখতে পারে। সে দিকে নজর দিয়েই মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন অবিরাম ছুটছেন কৃষকদের কাছে। আখচাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে এরই মধ্যে আখের মূল্য যেমন বাড়ানো হয়েছে, তেমনি তিনি সভা-সমাবেশ রেখেছেন অব্যাহত। এ ছাড়া কৃষকদের সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করণে নানামুখি পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছে। এ দিকে চিনি কারখানার দশা যাই হোক না কেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন থেকে প্রতি বছরের আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্র বেধে দিতে কমতি করেন না কর্তাবাবুরা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হোক বা না হোক বোঝা চাপিয়ে দিতে মোটেও ভুল হয় না করপোরেশনের। ৮৫ বছর বয়সী কেরুজ চিনিকলের ২০২২-২৩ আখ মাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর। লোকসান কমাতে অনেকটাই সাদা-মাটা পরিবেশে আলোচনাসভা ও দোয়া পরিচালনার মধ্যদিয়ে আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয়। বিগত কয়েক মরসুমের মতোই গত মরসুমেও লোকসান গুনতে হয় চিনি কারখানায়। ফলে ২০২১-২২ মরসুমের প্রায় ৬৪ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ২০২২-২৩ আখ মাড়াই মরসুমে যাত্রা শুরু করলেও মূল লক্ষ্য মুনাফা অর্জন ছিলো। ৫৩ দিনে ৬২ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াইয়ের লক্ষমাত্রা বেধে দেয়া হয়েছিলো বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন থেকে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের দেয়া লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ২০২২-২৩ আখ মাড়াই মরসুমে কেরুজ চিনিকলে ৬২ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করতে হবে ৩৮৪০ মেট্রিকটন। আখ মাড়াইয়ের গড়হার প্রতি মাড়াই দিবসে ১১৫০ মেট্রিকটন এবং চিনি আহরণের গড়হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। ০.৪২৩০ একর জমিতে আখ দন্ডায়মান ছিলো। যার মধ্যে কেরুজ নিজস্ব জমির পরিমান ০.১০৫০ একর। বাকী ০.৩১৮০ একর কৃষকদের জমিতে আখ চাষ করা হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিলো আখ মাড়াইয়ের ৪২ দিবস। আখ মাড়াই করেছে ৪৮ হাজার মেট্রিকটন আখ। ফলে বরাবরের মতো এ অর্থ বছরেও চিনি কারখানায় লোকসান গুনতে হয়েছে সাড়ে ৬৮ কোটি টাকা। এ দিকে ডিস্টিলারি বিভাগেও মুনাফা অর্জনের রেকর্ড ভেঙ্গেছে এবার। এবার ৬৯ লাখ ৬৭ হাজার প্রুপ লিটার মদ উৎপাদন করা হয়েছে কেরুজ ডিস্টিলারিতে। এর মধ্যে বাজারজাত করা হয়েছে ফরেণ লিকার (বিলেতি মদ) ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৫১ কেচ। এবার ফরেন লিকার (বিলেতি মদ) ও বাংলা মদ (দেশি মদ) বাজারজাত করা হয়েছে ৪৩৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার। যা গত অর্থ বছরের তুলনায় অনেকগুনে বেশি। ফলে ডিস্টিলারি বিভাগ থেকে মুনাফা অর্জন হয়েছে দেড়শ কোটি টাকা। এ ছাড়া আকন্দবাড়িয়া জৈব সার কারখানায় ১২ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে। তবে ৩০ বছরের লোকসানের রেকর্ড এবার ভেঙ্গেছে বানিজ্যিক খামারগুলোতে। এবার ৩০ বছর পর চিনিকলের ৯টি খামার থেকে ২৫ লাখ টাকা লাভের মুখ দেখেছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্স থেকে সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা দেয়া হয়ে ১৪৫ কোটি টাকা। চিনি কারখানার সাড়ে ৬৮ কোটি টাকা লোকসান পুষিয়েও ৮০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে কেরুজ কমপ্লেক্সে। কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি কেরুজ কমপ্লেক্স। সর্বক্ষেত্রে কেরুজ চিনিকলের রয়েছে অবদান। সরকারের এ মূল্যবান সম্পদ গর্বিত ও সমৃদ্ধ করেছে এ জেলা তথা দর্শনাকে। তাই এলাকার বৃহত্তর স্বার্থে এ প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য অন্যতম কাঁচামাল আখচাষ বাড়ানো খুবই জরুরি। কেরুজ কমপ্লেক্সে যে যেখানে যে যে দায়িত্বে রয়েছেন, তাদেরকে নিষ্টা, আন্তরিকতার মধ্যদিয়ে কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তাহলেই রক্ষা পাবে চিনি কারখানা, এ অঞ্চল ফিরে পাবে সোনালী অতীত। তাই আসুন কেরুজ চিনিকলকে বাচাই নিজেদের স্বার্থে, আর সেজন্য বেশি বেশি আখ চাষ করি। মনে রাখতে হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষকদের কথা বিবেচনা করেই বারবার আখের মূল্য বাড়াচ্ছেন, সেই সাথে কৃষকদের সুযোগ সুবিধায় তিনি আন্তরিক ভূমিকা রেখেছেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More